তারবিহীন বিদ্যুৎ প্রেরনে ডার্পার প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে?

জেনেনিন, কিভাবে কাজ করে তারবিহিন বিদ্যুৎ প্রেরনে ডার্পার প্রযুক্তি এবং এই প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ কি!

বিদ্যুৎ আমাদের আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই বিদ্যুৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে প্রয়োজন হয় তারের। আর, দুর্গম এলাকা বা সামরিক অপারেশনের মতো ক্ষেত্রে এই তারের সীমাবদ্ধতা বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এই সমস্যার সমাধানেই কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডারপা (DARPA), এবং সম্প্রতি, ডারপা দাবি করেছে যে তারা প্রায় ৮.৬ কিলোমিটার (৫.৩ মাইল) দূরত্ব অতিক্রম করে ৮০০ ওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সফলভাবে প্রেরণ করে এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। 

কিভাবে কাজ করে তারবিহীন বিদ্যুৎ এর এই প্রযুক্তি?

তারবিহীন বিদ্যুৎ
চলুন জেনেনেই, কিভাবে কাজ করে তারবিহীন এই প্রযুক্তি? | Image by Arek Socha from Pixabay

DARPA তাদের Persistent Optical Wireless Energy Relay (POWER) প্রোগ্রামের অধীনে তারবিহীন বিদ্যুৎ প্রেরণের জন্য একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে যা ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ পরিবহন ব্যবস্থার ধরণ বদলে দিতে পারে। এই প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হলো লেজার রশ্মির (Laser Beam) ব্যবহার। এখানে বিদ্যুৎকে প্রথমে একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার বিমে রূপান্তরিত করা হয়। এরপর এই লেজার রশ্মিকে একটি উৎস থেকে দূরবর্তী গ্রাহক যন্ত্রে (Receiver) পাঠানো হয়। 

এই প্রেরিত লেজার বিম-কে পুনরায় বিদ্যুতে রূপান্তরের জন্য ব্যবহৃত হয় Power Receiver Array Demo (PRAD) নামের একটি গ্রাহক যন্ত্র। এটি একটি বিশেষ নকশার গোলকাকার কাঠামো, যার কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র (aperture) রয়েছে। লেজার বিমটি এই ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই একটি প্যারাবোলিক আয়নার (parabolic mirror) উপর আঘাত করে। এই আয়না লেজার রশ্মিকে প্রতিফলিত করে সৌর কোষসমূহের (Photovoltaic cells) উপর পাঠায়। ফলস্বরূপ, এই ফটোভোল্টাইক সেলগুলো লেজার আলোকরশ্মিকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুতে রূপান্তর করে।

আরও দেখুনঃ টেসলা কয়েল কি? টেসলা কয়েল কিভাবে কাজ করে?

এই প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ

লেজার
লেজার প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রেরণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে | Photo by Claudio Rolli on Unsplash

যদিও ডারপা লেজার প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রেরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে এই প্রযুক্তির সামনে এখনো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, দক্ষতার দিক থেকে এখনো অনেক উন্নতির সুযোগ রয়েছে। লেজার বিমের মাধ্যমে শক্তি পাঠানোর সময় বায়ুমণ্ডলের প্রভাবের কারণে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি হারিয়ে যায়। প্রাথমিক পরীক্ষায় এই পদ্ধতির কার্যকারিতা প্রায় ২০% হিসেবে দেখা গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট নয় এবং উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে। 

দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। উচ্চ-ক্ষমতার লেজার বিম সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে তা ভুল লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, ফলে সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। 

তৃতীয়ত, এই প্রযুক্তির স্কেলাবিলিটি বা বৃহৎ আকারে প্রয়োগ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও ছোট আকারের পরীক্ষাগুলো ইতোমধ্যে সফল হয়েছে, কিন্তু বড় পরিসরে বাস্তবায়নের জন্য আরও গবেষণা ও উন্নয়ন দরকার। বর্তমানে ডারপা প্রায় ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে প্রেরণের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, যা সফল হলে প্রযুক্তিটির ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যাবে।

ডারপা এর POWER প্রোগ্রাম এর লক্ষ্য

ডারপার (DARPA) এই প্রোগ্রামের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হলো এমন একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করা, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনযোগ্য স্থান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দূরবর্তী এলাকায় বিদ্যুৎ পাঠাতে সক্ষম হবে।

এই প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সামরিক অপারেশন, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্র বা দুর্গম ঘাঁটিতে তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন কিংবা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এই প্রযুক্তি কার্যকর সমাধান দিতে পারে। 

একইভাবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ অবকাঠামো পুনর্গঠন না করেই দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া, ড্রোন ও ইউএভি (UAV)-এর মতো মানুষ বিহীন আকাশযানগুলোর দীর্ঘ সময় উড়তে নিরবচ্ছিন্ন শক্তি প্রয়োজন হয় যা এই প্রযুক্তি সেই চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।

ভবিষ্যতের আরও একটি সম্ভাবনাময় প্রয়োগ হলো মহাকাশ-ভিত্তিক সৌর শক্তি, যেখানে মহাকাশে সৌরশক্তি সংগ্রহ করে তা লেজারের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠানোর ধারণাকেও বাস্তবায়নযোগ্য করে তুলতে পারে এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তি।

ডারপা এর এই তারবিহীন বিদ্যুৎ প্রেরণ প্রযুক্তি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি সফল হলে ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, যা আমাদের জীবনযাত্রাকে আরও সহজ এবং কার্যকরী করে তুলবে বলে আশা করা যায়।
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments