আজকাল ছাদের ওপর সোলার প্যানেল লাগানোর কথা অনেকেই ভাবছেন, তাই না? বিদ্যুতের খরচ কমানো থেকে শুরু করে পরিবেশের কথা ভাবা – গ্রামাঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এর ব্যবহার এরকম অনেক কারণ আছে। কিন্তু বাজারে এত রকমের সোলার সিস্টেম আছে আর মধ্যে কোনটা যে বাড়ির জন্য সেরা সমাধান হবে সেটা নিয়ে অনেক সময় আমরা চিন্তায় পরে যাই, তাই এইসব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে দেখে নেওয়া যাক কিভাবে আপনি আপনার বাড়ির জন্য একটি আদর্শ সোলার সিস্টেম নির্বাচন করবেন।
প্রথমেই একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার – “সেরা” সোলার সিস্টেম বলে কিছু হয় না। আপনার বাড়ির বিদ্যুতের চাহিদা, ছাদের আকার ও ধরণ, বাজেট এবং আপনার ব্যক্তিগত লক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে কোন সিস্টেম আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। তবে কিছু বিষয় আছে যা আপনাকে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। চলুন, সেগুলো এক এক করে আলোচনা করা যাক।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
আপনার বিদ্যুতের চাহিদা

প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো আপনার বাড়ির দৈনিক অথবা মাসিক বিদ্যুতের চাহিদা কত, তার একটি বিস্তারিত হিসাব করা। এই কাজটি করার জন্য, আপনার বাড়িতে ব্যবহৃত সমস্ত ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, যেমন – বাতি, পাখা, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য সকল যন্ত্রপাতি দৈনিক বা মাসিক কত ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তার একটি সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক।
এই ধারণাটি আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে যে আপনার বাড়িতে কত কিলোওয়াটের একটি সোলার সিস্টেম স্থাপন করা প্রয়োজন। আপনার বিদ্যুৎ বিলগুলো পর্যালোচনা করলে এই বিষয়ে একটি ভালো ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সেখানে প্রতি মাসে আপনার মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখ থাকে।
বিদ্যুৎ বিল ছাড়াও, আপনি নিজে প্রতিটি যন্ত্রপাতির গায়ে লেখা ওয়াটেজ এবং দৈনিক ব্যবহারের সময়কাল হিসাব করে আপনার আনুমানিক বিদ্যুৎ চাহিদা বের করতে পারেন। প্রতিটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ওয়াটেজকে দৈনিক ব্যবহারের ঘণ্টার সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে দৈনিক ওয়াট-ঘণ্টা (Watt-hour) পাওয়া যায়। এই ওয়াট-ঘণ্টাকে ১০০০ দিয়ে ভাগ করলে কিলোওয়াট-ঘণ্টা (Kilowatt-hour) বা ইউনিট পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার বাড়িতে ৫টি ৬০ ওয়াটের বাতি দৈনিক ৫ ঘণ্টা করে জ্বলে, তাহলে সেগুলোর দৈনিক বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে:
5×60 ওয়াট×5 ঘণ্টা=1500 ওয়াট-ঘণ্টা=1.5 কিলোওয়াট-ঘণ্টা
একইভাবে, আপনার অন্যান্য সকল যন্ত্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার হিসাব করে সেগুলোকে যোগ করলে আপনার বাড়ির মোট দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে। মাসিক চাহিদা বের করার জন্য দৈনিক চাহিদাকে ৩০ দিয়ে গুণ করতে পারেন।
আপনার ছাদের পরিস্থিতি

আপনার ছাদের মোট ক্ষেত্রফল কত? এর মধ্যে কতটা জায়গা সোলার প্যানেল বসানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে? সাধারণত, পুরো ছাদ জুড়ে প্যানেল বসানো সম্ভব হয় না, কিছু জায়গা বাদ রাখতে হয়।
আপনার ছাদের দিক কোন দিকে? দক্ষিণমুখী ছাদ সাধারণত দিনের বেশিরভাগ সময় সরাসরি সূর্যের আলো পায়, যা সোলার প্যানেলের কার্যকারিতা বাড়ায়। পূর্ব বা পশ্চিমমুখী ছাদেও প্যানেল বসানো যায়, তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা কম হয়। উত্তরমুখী ছাদে সাধারণত তেমন কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না।
আপনার ছাদে দিনের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে ছায়া পড়ে কি? আশেপাশে উঁচু গাছপালা বা অন্য কোনো বাড়ির কারণে যদি ছায়া পড়ে, তাহলে সেই জায়গাগুলো সোলার প্যানেল বসানোর জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। এমনকি অল্প সময়ের জন্যও ছায়া পড়লে সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে।
আপনার ছাদের কাঠামো সোলার প্যানেলের ওজন নিতে পারবে তো? সোলার প্যানেল এবং তার কাঠামো বেশ ভারী হতে পারে। তাই একজন অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে আপনার ছাদের কাঠামো পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি। তিনি নিশ্চিত করতে পারবেন যে আপনার ছাদ অতিরিক্ত ওজন বহন করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী কিনা।
এছারা সোলারের প্রকারভে অনুযায়ী বাজারে মূলত তিন ধরনের সোলার সিস্টেম পাওয়া যায় এগুলো হলো –
গ্রিড-টাইড (Grid-tied) বা অন-গ্রিড

সুবিধা
- বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়
- সহজ স্থাপন ও কম খরচ
- অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ
অসুবিধা
- বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অকার্যকর
- সরকারি নীতির উপর নির্ভরশীলতা
- স্থান এবং আলোর প্রাপ্যতা
অন-গ্রিড সোলার সিস্টেম সরাসরি জাতীয় বিদ্যুতের গ্রিডের সাথে সংযুক্ত থাকে। দিনের বেলায় যখন সূর্যের আলো পর্যাপ্ত থাকে, তখন সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং সেই বিদ্যুৎ তাৎক্ষণিকভাবে আপনার বাড়ির বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম (যেমন – আলো, পাখা, টিভি, ইত্যাদি) চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। দিনের আলোয় আপনার বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর পরে যদি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, তবে সেই উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এর ফলে, আপনি আপনার অব্যবহৃত বিদ্যুতের জন্য আর্থিক সুবিধাও পেতে পারেন।
অন্যদিকে, রাতে অথবা মেঘলা দিনে যখন সোলার প্যানেল পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না, তখন এই সিস্টেম গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ গ্রহণ করে আপনার বাড়ির বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বিদ্যুতের জন্য আপনাকে কখনোই সম্পূর্ণরূপে সোলার প্যানেলের উপর নির্ভর করতে হয় না। এটি বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী একটি বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।
অফ-গ্রিড (Off-grid) বা স্ট্যান্ড-এলোন

সুবিধা
- সম্পূর্ণ স্বাধীনতা
- দীর্ঘমেয়াদী সাশ্রয়
- গ্রাম অঞ্চলে সুবিধা
- নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ
অসুবিধা
- প্রাথমিক খরচ বেশি
- বিদ্যুৎ উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা
- রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ঝামেলা
অফ-গ্রিড সোলার সিস্টেম, যা স্ট্যান্ড-alone সোলার সিস্টেম নামেও পরিচিত। এই সিস্টেমে দিনের বেলায় সোলার প্যানেল সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং এই বিদ্যুৎ এক বা একাধিক ব্যাটারিতে জমা রাখা হয়। এবং, যখন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তখন এই সঞ্চিত বিদ্যুৎ ইনভার্টারের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী এসি (অল্টারনেটিং কারেন্ট) বা ডিসি (ডিরেক্ট কারেন্ট) তে রূপান্তরিত করে বাড়ি বা অন্যান্য লোডে সরবরাহ করা হয়।
এই ধরনের সিস্টেম ওই সকল মানুষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী যারা দুর্গম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন, যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছানো কঠিন বা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। এছাড়াও, যারা পরিবেশ সচেতন এবং বিদ্যুতের জন্য সম্পূর্ণরূপে গ্রিডের উপর নির্ভর করতে চান না, তারাও এই স্বনির্ভর সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে বেছে নিতে পারেন।
হাইব্রিড (Hybrid)

সুবিধা
- নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ
- স্মার্ট লোড ম্যানেজমেন্ট
- বিদ্যুৎ গ্রিডের উপর কম নির্ভরতা
অসুবিধা
- স্থাপন খরচ বেশি
- ব্যাটারির সীমিত জীবনকাল
হাইব্রিড সোলার সিস্টেম ব্যাটারি এবং জাতীয় গ্রিড – উভয়ের সঙ্গেই সংযোগ থাকে। এটি মূলত অন-গ্রিড সিস্টেমের সুবিধা এবং অফ-গ্রিড সিস্টেমের বিদ্যুৎ সঞ্চয়ের ক্ষমতা – দুইয়ের সমন্বয়ে তৈরি। ফলে ব্যবহারকারীরা একদিকে যেমন জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়ে থাকেন, অন্যদিকে সোলার প্যানেল থেকে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে সংরক্ষণ করেও রাখতে পারেন।
যখন জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে না বা লোডশেডিং হয়, তখন সংরক্ষিত বিদ্যুৎ ব্যাটারি থেকে ব্যবহার করা যায়। আবার দিনের বেলা যখন সোলার প্যানেল থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় – যা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করা সম্ভব নয় – তখন সেই বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে জমা হয়ে পরে ব্যবহার করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি সিস্টেমটিকে করে তোলে আরও বেশি নির্ভরযোগ্য এবং স্থিতিশীল, বিশেষ করে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত বা ঘন ঘন লোডশেডিং হয়।
কাষ্টমাইজ ডিসি সোলার
উপরের সিস্টেমগুলো যদি আপনার দরকার না হয়। আপনি যদি স্বল্প খরচে একটি সোলার ডিসি সিস্টেম ব্যবহার করতে চান তাহলে কাষ্টমাইজ ডিসি সোলার আপনার জন্য একটি ভালো বিকল্প হতে পারে এখানে আপনি সোলার প্যানেল, চার্জ কন্ট্রোলার, ব্যাটারি এবং আরও কিছু ডিসি সরঞ্জাম এর মাধ্যমে একটি কাষ্টমাইজ ডিসি সোলার সিস্টেম তৈরি করে ব্যবহার পারেন। আপনি চাইলে স্থানীয় সোলার সিস্টেম সরবরাহকারীদের সাথে যোগাযোগ করে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কাষ্টমাইজড ডিসি সোলার সিস্টেম তৈরি করার জন্য পরামর্শ এবং সহযোগিতা নিতে পারেন। তারা আপনার চাহিদা অনুযায়ী সঠিক সরঞ্জাম নির্বাচন এবং সিস্টেম ডিজাইন করতে সাহায্য করতে পারবে।
আপনার বাজেট
সোলার সিস্টেমের খরচ নির্ভর করে এর আকার, গুণমান এবং ধরণের ওপর। আপনার বাজেট কত, তা আগে থেকে নির্ধারণ করা জরুরি। শুধু সিস্টেমের প্রাথমিক খরচ নয়, এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও মাথায় রাখতে হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করলে, সোলার সিস্টেম আপনার বিদ্যুতের বিল অনেক কমিয়ে আনতে পারে।
গুণমান এবং নির্ভরযোগ্যতা
সোলার প্যানেল, ইনভার্টার এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সরঞ্জাম কেনার সময় সেগুলোর গুণমান এবং নির্ভরযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের পণ্য নির্বাচন করা এবং পর্যাপ্ত ওয়ারেন্টি আছে কিনা তা যাচাই করে কেনা উচিৎ। উচ্চ গুণমান সম্পন্ন সরঞ্জাম দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থিতিশীল রাখবে এবং আপনার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমিয়ে আনবে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে
পরামর্শ থাকবে, কোনো একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসার আগে কয়েকজন অভিজ্ঞ সোলার ইনস্টলারের সাথে কথা বলুন। তারা আপনার বাড়ির পরিস্থিতি এবং চাহিদা অনুযায়ী সঠিক সিস্টেমের ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারবেন এবং একটি আনুমানিক খরচও জানাতে পারবেন তবে প্রতারক থেকে দূরে থাকবেন। বিভিন্ন কোম্পানির অফার তুলনা করে দেখুন এবং তাদের কাজের মান সম্পর্কে আগে নিশ্চিত হন এবং তাদের বিক্রয় পরবর্তী সেবা সম্পর্কে অবগত হন।
সোলার সিস্টেম একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ। একটু সময় নিয়ে এবং ভালোভাবে জেনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিলে আপনি নিশ্চিতভাবে আপনার বাড়ির জন্য সেরা সোলার সিস্টেমটি খুঁজে নিতে পারবেন।
আপনার যদি আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জিজ্ঞাসা করতে ভুলবেন না!