আধুনিক যুগে স্মার্টফোন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যোগাযোগ রাখা থেকে শুরু করে বিনোদন, তথ্য সংগ্রহ এবং আরও অনেক কিছুর জন্য আমরা আমাদের মোবাইল ফোনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন আমাদের অতি প্রয়োজনীয় এই ডিভাইসটি সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয় কোন কিছুতে ক্লিক করলে কাজ করে না, কেটে বের হতে চাইলে বের হয় না, একদম স্থির হয়ে যায়, আরও কত কি। বিশেষ করে ফোন যখন বার বার হ্যাং করে, তখন বিরক্তি চরমে পৌঁছায় অনেকে আবার রাগ ও করে বসেন।
কিন্তু চিন্তা নেই! কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করে আপনি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। আসুন, জেনে নেওয়া যাক ফোন বার বার হ্যাং করলে আপনার কী করা উচিত
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
ফোন রিস্টার্ট করুন

ফোন হ্যাং করার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী সমাধানগুলোর মধ্যে একটি হলো ফোন রিস্টার্ট করা। রিস্টার্ট করার প্রক্রিয়াটি হলো আপনার ফোনের চলমান সমস্ত কার্যক্রমকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া এবং পুনরায় সেগুলোকে নতুন করে চালু করা। এটি অনেকটা একটি রিফ্রেশ বাটনের মতো কাজ করে। যখন আপনি আপনার ফোন রিস্টার্ট করেন, তখন এর র্যাম (RAM) পরিষ্কার হয়ে যায় এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকা ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই ফোন হ্যাং করার মতো সমস্যা সহজেই সমাধান হয়ে যায় এবং আপনার ফোনটি আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে শুরু করে।
আপনার ফোন রিস্টার্ট করার জন্য সাধারণত “পাওয়ার বাটন” কয়েক সেকেন্ড ধরে প্রেস করে রাখা লাগে। কোনো কোনো ফোনে “পাওয়ার বাটনের” সাথে “ভলিউম আপ” অথবা “ভলিউম ডাউন” বাটন একইসাথে চেপে ধরতে হতে পারে। পাওয়ার বাটন চেপে ধরার পরে আপনার ফোনের স্ক্রিনে রিস্টার্ট (Restart) অথবা পুনরায় চালু (Reboot) করার একটি অপশন দেখতে পাবেন। সেই অপশনটিতে ট্যাপ করে আপনার ফোনটিকে রিস্টার্ট করুন।
অনেকে ফোন রিস্টার্ট করতে ভয় পান মনে করেন এটি করলে ফোনের সব ডেটা ডিলিট হয়ে যাবে কিন্তু এটা ভুল ধারনা রিস্টার্ট করলে সাধারানত কখনও এমনটা হয় না।
অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস বন্ধ করুন

আপনার স্মার্টফোন ব্যবহারের সময়, প্রায়শই এমন হয় যে আমরা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করি এবং ব্যবহারের পরে সেগুলোকে পুরোপুরি বন্ধ না করে রেখে দেই। এই অ্যাপগুলো ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকে এবং নীরবে ফোনের মূল্যবান প্রসেসিং ক্ষমতা (Processing Power) এবং র্যাম (RAM) ব্যবহার করতে থাকে। এর ফলে ফোন ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে হ্যাং (Hang) করার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
এই পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ পাওয়ার একটি সহজ এবং অত্যন্ত কার্যকর উপায় হলো রিসেন্ট অ্যাপস মেনুটি ব্যবহার করা। এখানে আপনি আপনার ব্যবহৃত অ্যাপগুলোর একটি তালিকা দেখতে পাবেন। এই মেনু থেকে অপ্রয়োজনীয় এবং বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে না এমন অ্যাপগুলোকে সোয়াইপ করে অথবা “বন্ধ করুন” অপশন ব্যবহার করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
আরও দেখুনঃ মোবাইল এর ব্যাটারি ভালো রাখার উপায়
ফোনের স্টোরেজ খালি করুন

ফোনের ইন্টারনাল স্টোরেজ যখন ভরে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই ফোন ধীরগতির হয়ে পড়ে এবং প্রায়শই হ্যাং করার মতো সমস্যা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে প্রথমত, ফোনের গ্যালারি, ডাউনলোড ফোল্ডার এবং অন্যান্য ফোল্ডারে থাকা অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো চিহ্নিত করে ডিলিট করে দিন। আমরা অনেকেই অনেক ছবি, ভিডিও বা ফাইল ডাউনলোড করে রাখি, যেগুলো পরবর্তীতে আর ব্যবহার করা হয় না। এই ধরনের ফাইলগুলো ফোনের স্টোরেজের একটি বড় অংশ দখল করে রাখে। নিয়মিতভাবে এই ফোল্ডারগুলো পরিষ্কার করলে অনেকটা জায়গা খালি করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, যদি আপনার ফোনে মেমোরি কার্ড ব্যবহারের সুযোগ থাকে, তাহলে বড় আকারের ফাইলগুলো, যেমন – আপনার তোলা ছবি ও ভিডিও অথবা অন্যান্য ভারী ফাইল মেমোরি কার্ডে সরিয়ে নিন। এতে আপনার ফোনের ইন্টারনাল স্টোরেজের ওপর চাপ কমবে এবং ফোন দ্রুত কাজ করতে পারবে।
আরও দেখুনঃ মোবাইল হ্যাক হওয়া থেকে বাঁচার উপায়
অ্যাপসের ক্যাশে এবং ডেটা পরিষ্কার করুন

দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন অ্যাপসের ক্যাশে এবং ডেটা আপনার ফোনে জমা হতে থাকে। এই অতিরিক্ত ক্যাশে এবং ডেটা জমার কারণে আপনার ফোনের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে, যার ফলে ফোন ধীরগতিতে কাজ করে এবং অপ্রত্যাশিত ত্রুটি দেখা দেয়।
এই সমস্যার সমাধানে, আপনাকে আপনার ফোনের সেটিংস-এ প্রবেশ করতে হবে। সেটিংস-এর মধ্যে, “অ্যাপ্লিকেশন ম্যানেজার” অথবা “অ্যাপস”-এর তালিকা খুঁজে বের করুন। এই তালিকায় আপনার ফোনে ইনস্টল করা সমস্ত অ্যাপসের একটি তালিকা দেখতে পাবেন।
এই তালিকা থেকে, যে অ্যাপটি সমস্যা সৃষ্টি করছে বলে আপনি সন্দেহ করছেন, সেটি খুঁজে বের করে সেটির উপর ক্লিক করুন। অ্যাপের বিস্তারিত তথ্য দেখার জন্য একটি নতুন পেজ খুলবে। এই পেজে আপনি “ক্যাশে পরিষ্কার করুন“ (Clear Cache) এবং “ডেটা পরিষ্কার করুন“ (Clear Data) নামক দুটি অপশন দেখতে পাবেন।
প্রথমে, ‘ক্যাশে পরিষ্কার করুন‘ বোতামটি চাপুন। এটি অ্যাপের সাময়িক ফাইলগুলো মুছে ফেলবে, যা প্রায়শই সমস্যার কারণ হয়। যদি এতেও কাজ না হয়, তবে আপনি ‘ডেটা পরিষ্কার করুন‘ বোতামটি ব্যবহার করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, ‘ডেটা পরিষ্কার করুন‘ অপশনটি ব্যবহার করলে আপনার লগইন তথ্য, সেটিংস এবং সংরক্ষিত ফাইলসহ অ্যাপের সমস্ত ডেটা মুছে যাবে। এর ফলে অ্যাপটি একেবারে নতুন করে শুরু হবে।
সফটওয়্যার আপডেট করুন

আপনার ফোনের সুরক্ষার জন্য এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিতভাবে অপারেটিং সিস্টেম এবং ইন্সটল করা অ্যাপস আপডেট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপডেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ত্রুটি (বাগ) সমাধান করা হয়, যা আপনার ফোনকে আরও স্থিতিশীল করে এবং অপ্রত্যাশিত ক্র্যাশ বা নিরাপত্তা ঝুঁকি কমায়। শুধু তাই নয়, অনেক সময় আপডেটের সাথে নতুন ফিচার যুক্ত হয় এবং ফোনের সামগ্রিক পারফরম্যান্সও উন্নত হয়, ফলে আপনার ফোন ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আরও ভালো হয়।
আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে নতুন আপডেট আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য, সাধারণত সেটিংস অ্যাপে গিয়ে “সফটওয়্যার আপডেট” (Software update) বা “সিস্টেম আপডেট” (System update) অপশনটি খুঁজে বের করুন। সেখানে ক্লিক করলে আপনার ফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন আপডেটের জন্য অনুসন্ধান করবে। যদি কোনো আপডেট পাওয়া যায়, তবে তা ডাউনলোড এবং ইনস্টল করার জন্য নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন। আপডেট করার সময় আপনার ফোনের ব্যাটারি পর্যাপ্ত পরিমাণে চার্জ দেওয়া আছে কিনা এবং একটি স্থিতিশীল ওয়াই-ফাই সংযোগ আছে কিনা তা নিশ্চিত করা উচিত।
অ্যাপসের ক্ষেত্রে, গুগল প্লে স্টোর (Google Play Store) অ্যাপে প্রবেশ করে “আমার অ্যাপস ও গেমস“ (My apps & games) অথবা “অ্যাপস পরিচালনা করুন“ (Manage apps & device) অপশনে গিয়ে আপনি ইন্সটল করা অ্যাপসের আপডেটের তালিকা দেখতে পারবেন। সেখান থেকে আপনি হয় সব অ্যাপ একসাথে আপডেট করতে পারবেন, অথবা নির্দিষ্ট কোনো অ্যাপ বেছে নিয়ে আপডেট করতে পারবেন।
আইওএস অপারেটিং সিস্টেমে অটোমেটিক আপডেটের সুবিধা রয়েছে। এই সেটিংসটি খুঁজে পেতে আপনার আইফোন ডিভাইসের “সেটিংস” অ্যাপটি ওপেন করুন এবং স্ক্রল করে “অ্যাপ স্টোর” অপশনে প্রবেশ করুন। “স্বয়ংক্রিয় ডাউনলোড” (Automatic Downloads) বিভাগের অধীনে “অ্যাপ আপডেট” (App Updates) নামক অপশনটির পাশে থাকা সুইচটি অন করে দিন (সবুজ রঙে)।
এই অপশনটি চালু করলে যখনই কোনো অ্যাপের নতুন সংস্করণ আসবে, আপনার আইফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওয়াই-ফাই এর মাধ্যমে সেটি ডাউনলোড এবং ইনস্টল করে নেবে
আরও দেখুনঃ মোবাইল হ্যাক থেকে বাঁচার উপায়
থার্ড-পার্টি লঞ্চার ব্যবহার বন্ধ করুন

কিছু থার্ড-পার্টি লঞ্চার আপনার ফোনের কর্মক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই লঞ্চারগুলো ব্যাকগ্রাউন্ডে অতিরিক্ত প্রসেস এবং রিসোর্স ব্যবহার করে, যার ফলে আপনার ফোন ধীর হয়ে যেতে পারে, হ্যাং করতে পারে অথবা ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যেতে পারে।
আপনি যদি বর্তমানে কোনো থার্ড-পার্টি লঞ্চার ব্যবহার করে থাকেন এবং আপনার ফোনে হ্যাং বা ধীরগতির সমস্যা অনুভব করেন, তাহলে কিছুদিনের জন্য সেই লঞ্চারটি বন্ধ করে আপনার ফোনের ডিফল্ট লঞ্চার ব্যবহার করে দেখা একটি ভালো উপায় হতে পারে। এর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন যে থার্ড-পার্টি লঞ্চারটিই আপনার সমস্যার কারণ কিনা।
ফ্যাক্টরি রিসেট করুন (সাবধানে)

যদি উপরের কোনো পদ্ধতিতেই কাজ না হয়, তবে শেষ উপায় হিসেবে আপনি ফোন ফ্যাক্টরি রিসেট করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, ফ্যাক্টরি রিসেট করলে আপনার ফোনের সমস্ত ডেটা (যেমন – ছবি, ভিডিও, অ্যাপস, কন্টাক্ট) মুছে যাবে। তাই রিসেট করার আগে অবশ্যই আপনার গুরুত্বপূর্ণ ডেটার ব্যাকআপ নিয়ে রাখুন। ফ্যাক্টরি রিসেট করার জন্য সেটিংস-এ জান এবং সেখানে ‘ব্যাকআপ অ্যান্ড রিসেট‘ অপশনে গিয়ে ফ্যাক্টরি ডেটা রিসেট করার অপশনটি খুঁজে পাবেন।
আরও দেখুনঃ মোবাইল এ পানি ঢুকলে কি করনীয়?
সার্ভিস সেন্টারে যোগাযোগ করুন

যদি উপরের সকল কাজ করার পরেও আপনার ফোনের হ্যাং করার সমস্যা সমাধান না হয়, তবে সম্ভবত আপনার ফোনের হার্ডওয়্যারে কোনো সমস্যা আছে। সেক্ষেত্রে দেরি না করে নিকটস্থ সার্ভিস সেন্টারে যোগাযোগ করুন এবং অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানদের সাহায্য নিন।
ফোন হ্যাং করা এড়াতে কিছু সতর্কতা
- নিয়মিতভাবে অপ্রয়োজনীয় ফাইল এবং অ্যাপ সরিয়ে ফেলুন।
- ফোনের সফটওয়্যার আপ-টু-ডেট রাখুন।
- একসাথে অনেক অ্যাপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- অজানা উৎস থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করা এড়িয়ে চলুন।
- সময় সময় ফোনের ক্যাশে মেমরি পরিষ্কার করুন।
আশা করি, এই টিপসগুলো আপনার ফোন হ্যাং করার সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে এবং আপনি আপনার স্মার্টফোনটিকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। যদি আপনার অন্য কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।