“মাছে ভাতে বাঙালি” – এই প্রবাদটি যেন আমাদের রক্তে মিশে আছে তেমনি মাছ শুধু আমাদের খাদ্য তালিকার একটি অংশ নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতিরও প্রতিচ্ছবি। রুই, কাতলা, ইলিশ কিংবা ছোট মাছের চচ্চড়ি – জিভে জল আনা এই পদগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। তবে মাছের স্বাদ নিতে গিয়ে মাঝে মাঝে যে অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনাটি ঘটে, তা হলো গলায় কাঁটা আটকে যাওয়া।
এই অভিজ্ঞতা কমবেশি সকলের জীবনেই একবার না একবার হয়েছে। গলায় কাঁটা আটকালে একদিকে যেমন তীব্র অস্বস্তি হয়, তেমনই একটা চাপা ভয়ও কাজ করে – “যদি না বের হয়?” “কী হবে?” ইত্যাদি নানা দুশ্চিন্তা ভিড় করে আসে মনে।
তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। গলায় কাঁটা আটকালে বেশিরভাগ সময় কিছু সহজ ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
গলায় কাঁটা আটকালে প্রথমে যা করবেন
প্রথমত, একদমই ঘাবড়াবেন না। আতঙ্কিত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। শান্তভাবে শ্বাস নিন এবং কাশির চেষ্টা করুন। অনেক সময় হালকা কাশি দিলেই কাঁটা বেরিয়ে আসে। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখুন, তারপর জোরে কয়েকবার কাশুন। কাশির ধাক্কায় কাঁটা মুখ বা গলার দিকে উঠে আসতে পারে। যদি সম্ভব হয়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বা অন্য কারো সাহায্যে গলার ভেতর দেখার চেষ্টা করুন। যদি কাঁটাটি দৃশ্যমান হয় এবং সহজেই নাগালের মধ্যে থাকে, তবে সাবধানে তা বের করার চেষ্টা করতে পারেন। তবে নিজে চেষ্টা করতে গিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করবেন না।
যদি কাঁটাটি বেশি গভীরে আটকে থাকে বা আপনি নিজে তা বের করতে না পারেন, তবে নিচের পদ্ধতিগুলো চেষ্টা করতে পারেনঃ
রুটি বা ভাতের গোলা

রুটি বা সেদ্ধ ভাতের ছোট ছোট গোলা তৈরি করুন এবং এই গোলাগুলো এমন আকারের হতে হবে যাতে আপনি সহজেই গিলে ফেলতে পারেন। এরপর, এই গোলাগুলোকে সামান্য জল দিয়ে নরম করুন। নরম করার কারণ হলো, শুকনো বা শক্ত গোলা গিলতে অসুবিধা হতে পারে এবং তা আরও অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
যখন গোলাগুলো যথেষ্ট নরম হবে, তখন একটি একটি করে গিলে ফেলুন। মনে রাখবেন, তাড়াহুড়ো করবেন না, ধীরে ধীরে গিলুন। এই শুকনো রুটি বা ভাতের নরম গোলাগুলো খাদ্যনালী দিয়ে যাওয়ার সময় আটকে থাকা কাঁটাকে টেনে নিচে, অর্থাৎ পাকস্থলীর দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। পাকস্থলীতে অ্যাসিড থাকে যা কাঁটাকে দ্রবীভূত করতে পারে বা ভোঁতা করে দিতে পারে, ফলে discomfort দূর হয়।
কলার সাহায্য

পাকা কলার ভেতরের অংশ বেশ নরম এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে। যখন এই পাকা কলা খাওয়া হয়, তখন এর পিচ্ছিল ভাব গলার আটকে থাকা কাঁটার চারপাশে একটি আস্তরণ তৈরি করে। এর ফলে কাঁটার ধারালো দিকটি কিছুটা মসৃণ হয়ে আসে এবং খাদ্যনালীর ভেতরে আর তেমন ধারালোভাবে বিঁধতে পারে না।
কলা গেলা সহজ হওয়ায়, এটি যখন খাদ্যনালী দিয়ে নিচে নামতে থাকে, তখন এর মৃদু চাপ এবং পিচ্ছিলতা আটকে থাকা কাঁটাকে ধীরে ধীরে পেটের দিকে ঠেলে দিতে সাহায্য করে।
লেবুর রস

এক গ্লাস হালকা গরম জল নিন। এই জলের মধ্যে সামান্য পরিমাণে, প্রায় এক চা চামচের মতো, তাজা লেবুর রস মেশান। ভালোভাবে মিশিয়ে, এই মিশ্রণটি ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে পান করুন। গরম জল গলার ভেতরের অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করবে এবং লেবুর অ্যাসিডিক উপাদান খাদ্যনালীতে আটকে থাকা কাঁটাকে নরম করতে পারে। যদি কাঁটা নরম হয়, তবে সেটি সহজেই নিচে নেমে যেতে পারবে এবং আপনার অস্বস্তি দূর হবে।
জলপাই তেল (Olive Oil)

কাঁটা নামানোর জন্য এক চামচ বিশুদ্ধ জলপাই তেল পান করতে পারেন। জলপাই তেলের পিচ্ছিল ভাব কাঁটার চারপাশে একটি আস্তরণ তৈরি করতে পারে, যা কাঁটাকে পিছলে যেতে এবং আপনার গলা থেকে নেমে যেতে সাহায্য করতে পারে। এটি একটি সহজ এবং ঘরোয়া উপায়, যা অনেক সময় বেশ ভালো কাজ করে।
সিরকা (Vinegar)

সামান্য জলের সাথে অল্প পরিমাণে ভিনেগার মিশিয়ে ধীরে ধীরে পান করতে পারেন। ভিনেগারের মধ্যে থাকা অ্যাসিডিক উপাদান মাছের কাঁটাকে নরম করতে সাহায্য করে, যার ফলে কাঁটাটি সহজেই গলা থেকে নেমে যেতে পারে। তবে এই বিষয়টি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কখনোই সরাসরি বা খুব বেশি পরিমাণে ভিনেগার পান করা উচিত নয়। ভিনেগার একটি শক্তিশালী অ্যাসিড এবং এর অতিরিক্ত ব্যবহার আপনার খাদ্যনালীর ক্ষতি করতে পারে। তাই অল্প পরিমাণে জলের সাথে মিশিয়ে পান করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যে কাজগুলো করবেন না
জোর করে ঢোক গেলার চেষ্টা করা
অনেকেই মনে করেন, বারবার ঢোক গিললে বা বড় কোনো খাবার গিলে ফেললে কাঁটা নেমে যাবে। কিন্তু জোর করে ঢোক গেলার চেষ্টা করলে কাঁটা আরও গভীরে চলে যেতে পারে বা খাদ্যনালীর নরম টিস্যুতে আঘাত করতে পারে।
আঙুল বা অন্য কিছু দিয়ে বের করার চেষ্টা করা
গলায় হাত ঢুকিয়ে বা অন্য কোনো জিনিস দিয়ে কাঁটা বের করার চেষ্টা করা বিপজ্জনক। এতে বমি আসতে পারে বা কাঁটা আরও ভেতরে চলে যেতে পারে। তাছাড়া, অপরিষ্কার হাতের কারণে সংক্রমণও হতে পারে।
কাশির মাধ্যমে বের করার চেষ্টা না করা
যদিও হালকা কাশি দিয়ে অনেক সময় ছোট কাঁটা বেরিয়ে আসে, তবে অতিরিক্ত করে বা ভুল পদ্ধতিতে কাশলে লাভের থেকে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
অতিরিক্ত পানি বা তরল পান না করা
অনেকেই মনে করেন পানি পান করলে কাঁটা নেমে যাবে। তবে অনেক সময় শুধু পানি পান করলে কাঁটা আরও শক্তভাবে আটকে যেতে পারে বা খাদ্যনালীর দেয়ালে ঘষা লেগে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা
যদি কাঁটা আটকে থাকার পরেও আপনি কোনো পদক্ষেপ না নেন এবং দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেন, তবে এটি খাদ্যনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। তাই দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ভুল ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করা
না জেনে বা ভুল শুনে অনেক ধরনের ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করা উচিত নয়। যেমন, শুকনো ভাত বা মুড়ি গেলানোর চেষ্টা করা অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন

উপরের ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করার পরেও যদি গলায় আটকে থাকা কাঁটা বের না হয়, অথবা যদি ক্রমশ তীব্র ব্যথা, ঢোক গিলতে অসুবিধা, শ্বাস নিতে কষ্ট, একটানা কাশি (বিশেষত কাশির সাথে রক্ত বের হলে), বারবার বমি পাওয়া বা বমি হওয়ার প্রবণতা, গলায় বা বুকে অস্বস্তি অথবা কাঁটার অবস্থান দৃশ্যমান না হয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। সাধারণত, ডাক্তার এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে এই কাঁটা বের করে থাকেন। তাই কোনো রকম বিলম্ব না করে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে শিশুদের গলায় কাঁটা আটকালে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন, কারণ তারা তাদের অস্বস্তি সঠিকভাবে বোঝাতে পারে না এবং তাদের শ্বাসনালীও তুলনামূলকভাবে ছোট থাকে। আমাদের দেশে প্রচলিত বিড়ালের পা ধরলে কাঁটা নেমে যাওয়ার মতো কুসংস্কারে বিশ্বাস না করে, যদি ঘরোয়া উপায়গুলো কাজে না দেয় তবে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
মন্তব্য
মাছ খাওয়ার সময় একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে গলায় কাঁটা আটকে যাওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়। ছোট বাচ্চাদের মাছ খাওয়ানোর সময় বিশেষ খেয়াল রাখুন এবং কাঁটা ছাড়িয়ে খাওয়ান। তাড়াহুড়ো করে মাছ খাবেন না।
গলায় মাছের কাঁটা আটকালে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে সহজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে প্রয়োজনে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন!