সকাল হলো একটি নতুন দিনের শুরু। দিনের শুরুতে আমরা যা করি, তার প্রভাব সারাদিনের ওপর পড়তে থাকে। একটি সুন্দর ও প্রাণবন্ত সকাল আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে, মনকে প্রফুল্ল রাখতে এবং দিনের অন্যান্য কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। কিন্তু আমরা অনেকেই না জেনে এমন কিছু কাজ করে ফেলি যা আমাদের সকালের সেই মূল্যবান সময়টিকে নষ্ট করে দেয়, এমনকি দিনের বাকি অংশেও এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তাই আজ আমরা আলোচনা করব এমন ৫টি কাজ নিয়ে যা আমাদের সকালবেলা এড়িয়ে চলা উচিত। এই অভ্যাসগুলো ত্যাগ করে আপনি আপনার দিনের শুরুটা আরও ইতিবাচক এবং উৎপাদনশীল করে তুলতে পারেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই কাজগুলো কী কী এবং কেন সেগুলো আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
ঘড়ির অ্যালার্ম ‘স্নুজ’ করা

সকালে অ্যালার্মের মিষ্টি (কিংবা তিক্ত!) আওয়াজ আমাদের কানে ভেসে আসে এবং আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু আমরা অনেকেই আরও কিছুক্ষণ ঘুমের লোভে ‘স্নুজ’ বোতামটি চাপি। মনে হয়, আরও বাড়তি কয়েক মিনিট ঘুমানো আমাদের তরতাজা করে তুলবে। তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বারবার অ্যালার্ম ‘স্নুজ’ করা আসলে আমাদের ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দকে নষ্ট করে দেয়।
আমাদের ঘুমের প্রক্রিয়াটি কয়েকটি নির্দিষ্ট ধাপে সম্পন্ন হয় – যেমন হালকা ঘুম, গভীর ঘুম এবং REM(Rapid Eye Movement)। সকালে যখন অ্যালার্ম বেজে ওঠে, তখন আমরা ঘুমের যে স্তরেই থাকি না কেন, স্নুজ বোতাম টিপে পুনরায় ঘুমালে আমাদের শরীর একটি নতুন ঘুমের চক্রের শুরু করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার অ্যালার্ম বেজে উঠলে সেই চক্রটি সম্পূর্ণ হতে পারে না। এর ফলে আমরা আরও বেশি ক্লান্ত এবং ঝিমুনি অনুভব করি, যাকে ‘স্লিপ ইনারশিয়া’ বলা হয়। এই কারণে অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে ওঠা অনেক বেশি উপকারী। প্রথম কয়েক দিন কষ্ট হলেও, ধীরে ধীরে শরীর এই নতুন রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নেবে এবং আপনি সতেজ অনুভব করবেন।
মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা

ঘুম থেকে উঠেই স্মার্টফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলানো আজকাল একটি সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন, ইমেইল অথবা অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনের বার্তা দেখতে দেখতে বিছানায় অনেকটা সময় পার করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই অভ্যাসটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই যখন আমরা বিভিন্ন তথ্য ও আপডেটের ভিড়ে নিজেদের ডুবিয়ে দিই, তখন আমাদের মস্তিষ্কে অপ্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের জীবনযাত্রা দেখে নিজেদের সঙ্গে তুলনা করা বা নেতিবাচক খবরগুলি পড়া মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে। দিনের শুরুতেই মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে দিনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিতে মন বসানো কঠিন হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে, সকালে কিছু সময় নিজের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। ধ্যান, যোগাআসন, হালকা ব্যায়াম অথবা পছন্দের কোনো বই পড়া মনকে শান্ত করে এবং দিনের জন্য একটি ইতিবাচক সূচনা এনে দেয়।
সকালের নাশতা বাদ দেওয়া

অনেকেই ওজন কমানোর ভুল ধারণায় অথবা তাড়াহুড়োর কারণে সকালের নাশতা (Breakfast) এড়িয়ে যান। কিন্তু দীর্ঘ রাতের ঘুমের পর আমাদের শরীরকে পুনরায় সক্রিয় হওয়ার জন্য জ্বালানির প্রয়োজন। সকালের নাশতা বাদ দিলে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়। এর ফলে সারা দিন দুর্বলতা, ক্লান্তি এবং মনোযোগের অভাব অনুভূত হতে পারে।
একটি স্বাস্থ্যকর সকালের নাশতা আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায় এবং কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ডিম, ওটস, ফল, বাদাম এবং দইয়ের মতো পুষ্টিকর খাবার সকালের নাস্তায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যারা ওজন কমাতে চান, তাদেরও একটি সুষম নাস্তা করা উচিত, যা তাদের দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করবে এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের প্রবণতা কমাবে। মনে রাখবেন, সকালের নাশতা দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবার এবং এটি আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
নেগেটিভ চিন্তা করা বা অভিযোগ করা

সকালে ঘুম থেকে উঠেই যদি মন খারাপ থাকে বা কারো প্রতি অভিযোগের ভাবনা মাথায় ঘুরতে থাকে, তাহলে পুরো দিনটাই নেতিবাচকতায় ভরে যেতে পারে। আমাদের চিন্তাভাবনা আমাদের অনুভূতিকে প্রভাবিত করে এবং দিনের শুরুতে নেতিবাচক চিন্তা করলে মানসিক চাপ বাড়ে এবং কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়।
দিনের শুরুটা ইতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে করা উচিত। প্রতিদিন সকালে কিছু সময় বের করে সেই জিনিসগুলির কথা ভাবুন যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ। এটি আপনার মনকে শান্ত করবে এবং একটি ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি হবে। সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করুন এবং দিনের ছোট ছোট আনন্দগুলো উপভোগ করুন। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে দিন শুরু করলে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হয় এবং কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়ে।
তাড়াহুড়ো করে দিন শুরু করা

সকালে ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা বা পর্যাপ্ত সময়ের অভাবের কারণে অনেকেই তাড়াহুড়ো করে দিনের কাজ শুরু করেন। দ্রুত পোশাক পরা, নাস্তা না করেই বেরিয়ে যাওয়া অথবা অন্যান্য কাজ তাড়াহুড়ো করে করার ফলে দিনের শুরুতেই একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই তাড়াহুড়োর কারণে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভুলে যাওয়া বা ভুল করার সম্ভাবনা থাকে।
একটি শান্ত ও পরিকল্পিত সকাল পুরো দিনের জন্য একটি স্থিতিশীল ভিত্তি স্থাপন করে। আগের রাতে পোশাক গুছিয়ে রাখা, সকালের নাস্তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা এবং ঘুম থেকে একটু আগে ওঠা এই তাড়াহুড়ো এড়াতে সাহায্য করতে পারে। ধীরে ধীরে এবং শান্তভাবে দিনের শুরু করলে মানসিক চাপ কমে এবং কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়ে। সময় নিয়ে প্রস্তুত হলে দিনের অন্যান্য কাজগুলিও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়।
পরিশেষে উল্লেখ্য
সকালবেলা একটু সচেতন হলেই আপনার পুরো দিনটা হতে পারে অনেক বেশি প্রোডাকটিভ, শান্তিপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক। তাই এই ভুল কাজগুলো থেকে বিরত থাকুন এবং সকালে ভালো অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং নিজেকে সকলের কাছে একজন স্মার্ট মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন।