চুঁইঝাল… নামটা শুনলেই যেন জিভে জল এসে যায়! এর মাদকতাময় গন্ধ আর ঝাঁঝালো স্বাদ যেকোনো সাধারণ রান্নাকে অসাধারণ করে তোলে। বিশেষ করে চুঁইঝাল আর খাসির মাংসের এই যুগলবন্দী ভোজনরসিকদের কাছে যেন এক পরম প্রাপ্তি, এক অমৃতের আস্বাদ। তবে হ্যাঁ, অনেকের মনেই একটা দ্বিধা কাজ করে – চুঁইঝাল রান্না করা বুঝি বেশ কঠিন, বুঝি এর জন্য বিশেষ কোনো দক্ষতার প্রয়োজন। তাই, আজকের আমি আপনাদের জানাবো চুঁইঝালের একটি সহজ রেসিপি, যা অনুসরণ করে আপনিও ঘরে বসেই উপভোগ করতে পারবেন এই অমৃত স্বাদ।
কী এই চুঁইঝাল?

যারা এখনো চুঁইঝালের জাদুকরী স্বাদ অনুভব করেননি, তাদের জন্য একটু বিস্তারিতভাবে বলা যাক। চুঁইঝাল কেবল একটি লতানো গাছ নয়, এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলের মানুষের রসনা ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গাছের কাণ্ড, শিকড় এবং ডাল—প্রত্যেকটি অংশই মশলার ভাণ্ডার। এর বিশেষত্ব হলো এর স্বাদ। প্রথম কামড়ে মনে হবে যেন তীব্র ঝালের এক ঝলক, কিন্তু এই ঝাঁজ খুব দ্রুতই এক মিষ্টি ও উষ্ণ আবেশে পরিবর্তিত হয়, যা অন্য কোনো ঝাল মসলার মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যই চুঁইঝালকে অন্যান্য মসলা থেকে আলাদা করে এবং খাদ্যরসিকদের কাছে এটিকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে।
খুলনা অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন রান্না থেকে শুরু করে বিশেষ অনুষ্ঠানেও চুঁইঝালের ব্যবহার দেখা যায়। মাছ, মাংস কিংবা সবজি—সবকিছুতেই এর সামান্য যোগান খাবারের স্বাদকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। শুধু স্বাদ নয়, চুঁইঝালের ঔষধি গুণাগুণও রয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস করা হয়। হজমকারক এবং ব্যথানাশক হিসেবেও এর ব্যবহার প্রচলিত আছে।
তাহলে আর দেরি না করে, আসুন জেনে নেওয়া যাক এই পদটি তৈরির প্রণালী।
যে উপকরন লাগবে
- ১ কেজি খাসির মাংস (হাড়সহ অথবা হাড়ছাড়া)
- ২৫০ গ্রাম চুঁইঝাল (কাণ্ড ছোট টুকরা করে কাটা)
- ২টি বড় পেঁয়াজ কুচি
- ২ টেবিল চামচ আদা বাটা
- ২ টেবিল চামচ রসুন বাটা
- ১ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো
- ১ চা চামচ মরিচ গুঁড়ো (স্বাদ অনুযায়ী)
- ১ চা চামচ জিরা গুঁড়ো
- ১/২ চা চামচ ধুনিয়া গুঁড়ো
- ২-৩টি তেজপাতা
- ২-৩টি এলাচ
- ২-৩টি লবঙ্গ
- ২ টুকরা দারুচিনি
- স্বাদ অনুযায়ী লবণ
- পরিমাণ মতো তেল
রান্নার প্রণালী

- প্রথমে পিস করে রাখা খাসির মাংস ভালো করে ধুয়ে নিন।
- একটি পাত্রে মাংসের সাথে আদা বাটা, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো, ধুনিয়া গুঁড়ো এবং লবণ মিশিয়ে ভালোভাবে মেখে নিন। অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ম্যারিনেট করে রাখুন।
- একটি কড়াইতে তেল গরম করুন। তেল গরম হলে তেজপাতা, এলাচ, লবঙ্গ ও দারুচিনি দিয়ে একটু ভেজে নিন।
- এরপর করাইতে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে দিন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত ভাজুন যতক্ষণে হালকা বাদামী রঙ না হয়।
- এরপরে ম্যারিনেট করা মাংস কড়াইতে দিয়ে দিন এবং মাঝারি আঁচে ভালোভাবে কষাতে থাকুন। মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করুন যাতে মাংস তলায় লেগে না যায়।
- যখন মাংস থেকে তেল ছেড়ে আসবে, তখন চুঁইঝালের টুকরোগুলো দিয়ে দিন।
- আরও কিছুক্ষণ (৫-৭ মিনিট) মাংসের সাথে চুঁইঝাল কষিয়ে নিন। এই সময় চুঁইঝালের সুগন্ধ মাংসের সাথে মিশে যাবে।
- প্রয়োজন অনুযায়ী গরম পানি যোগ করুন (মাংস সেদ্ধ হওয়ার জন্য যতটুক পানি প্রয়োজন)।
- এরপরে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন এবং প্রায় ৩০-৪০ মিনিট মাঝারি আঁচে মাংস সেদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন।
- মাংস সেদ্ধ হয়ে গেলে এবং ঝোল ঘন হয়ে এলে লবণ চেখে নিন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী লবণ যোগ করুন।
- কিছুক্ষণ চুলায় রেখে নামিয়ে নিন।
ব্যস! তৈরি হয়ে গেল সুস্বাদু খাসির মাংস দিয়ে চুঁইঝাল। গরম গরম ভাত অথবা রুটির সাথে পরিবেশন করুন এবং উপভোগ করুন চুঁইঝালের সেই মন মাতানো স্বাদ।
চুঁইঝালের অন্যান্য ব্যবহার
খাসির মাংস ছাড়াও চুঁইঝাল বিভিন্নভাবে রান্না করা যায়। যেমন –
- চিংড়ি মাছ দিয়ে চুঁইঝালঃ এটিও একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ।
- ডিম দিয়ে চুঁইঝালঃ যারা মাংস পছন্দ করেন না, তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার বিকল্প।
- সবজির সাথে চুঁইঝালঃ বিভিন্ন সবজির সাথে সামান্য চুঁইঝাল যোগ করলে স্বাদ অনেক বেড়ে যায়।
সতর্কতা
চুঁইঝাল একটি ঝাঁজালো মসলা। যারা প্রথমবার এটি ব্যবহার করছেন, তাদের অল্প পরিমাণে ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে স্বাদের সাথে পরিচিত হয়ে পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।
এই রেসিপিটি অনুসরণ করে আপনিও খুব সহজেই বাড়িতে তৈরি করতে পারবেন চুঁইঝালের স্বাদযুক্ত খাসির মাংসের এই অসাধারণ পদটি। আশা করি, আপনাদের ভালো লাগবে! আপনার রান্নার অভিজ্ঞতা কেমন হলো? কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।