গাড়িতে চড়লেই বমি পায়? জেনে নিন সমাধান!

মোশন সিকনেস থেকে মুক্তি পেতে জেনেনিন কিছু সহজ এবং কার্যকর উপায়

আমাদের অনেকেরই গাড়িতে চড়লেই বমি পায় যা একটি অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা। এই সমস্যাটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মোশন সিকনেস (Motion Sickness)। বাস, ট্রেন, গাড়ি, বিমান এমনকি নৌযানেও এই সমস্যা হতে পারে। বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা, এবং শেষ পর্যন্ত বমি হয়ে যাওয়া – এই লক্ষণগুলো মোশন সিকনেসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই! কিছু কার্যকর উপায় জানা থাকলে এই সমস্যা অনেকটাই কমানো সম্ভব। তাই আজকে আমরা মোশন সিকনেস কেন হয়? এবং এর থেকে মুক্তির উপয় কি সেই সম্পর্কে জানব।

মোশন সিকনেস কেন হয়?

গাড়িতে চড়লেই বমি পায়
জেনেনিন, মোশন সিকনেস কেন হয়? | Photo by Patrick Shaun on Unsplash

আমাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য মস্তিষ্ক চোখ, কান এবং পেশী থেকে বিভিন্ন সংকেত গ্রহণ করে। যখন এই সংকেতগুলোর মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, তখনই মোশন সিকনেসের সৃষ্টি হয়। ধরুন, আপনি গাড়িতে বসে আছেন এবং আপনার চোখ দেখছে যে আপনি স্থির আছেন, কিন্তু আপনার কানের ভেতরের ভেস্টিবুলার সিস্টেম (যা ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে) মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাচ্ছে যে আপনি গতিশীল। এই দুই ধরনের সংকেতের কারণেই মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং এর ফলস্বরূপ বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা এবং দুর্বল লাগার মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়।

তবে, মোশন সিকনেস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু সহজ এবং কার্যকর উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। চলুন দেখে নেওয়া যাক কি কি করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ভ্রমণের আগে ও ভ্রমণ চলাকালীন খাদ্যাভ্যাস

প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি
ভ্রমনের অন্তত ২-৩ ঘণ্টা আগে হালকা কিছু খাবার খেয়ে নিন | Photo by engin akyurt on Unsplash

খাদ্যাভ্যাস মোশন সিকনেস নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাত্রার অন্তত ২-৩ ঘণ্টা আগে হালকা খাবার খাওয়া উচিত। তেল-মসলাযুক্ত, চর্বিযুক্ত বা অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তার পরিবর্তে স্যান্ডউইচ, বিস্কুট, ফলমূল বা হালকা স্যুপ খেতে পারেন। তবে একদম খালি পেটে যাত্রা করাও উচিত নয়, কারণ এতে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেড়ে বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে। 

পর্যাপ্ত পানি পান করাও জরুরি, কারণ ডিহাইড্রেশন মোশন সিকনেসের উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে। যাত্রার আগে এবং ভ্রমণ চলাকালীন অল্প অল্প করে পানি পান করুন, তবে কোমল পানীয় বা অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন।

আদা মোশন সিকনেস দূর করতে দারুণ কার্যকর একটি প্রাকৃতিক উপাদান। যাত্রার আগে আদা চা পান করা, অথবা ছোট একটি আদার টুকরা মুখে নিয়ে চিবানো যেতে পারে। আদাযুক্ত বিস্কুট বা লজেন্সও উপকারে আসতে পারে, কারণ আদা হজমে সাহায্য করে এবং বমি বমি ভাব কমায়। এছাড়াও, সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন লেবু বা কমলা মোশন সিকনেস থেকে কিছুটা আরাম দিতে পারে। এই ধরনের ফলের গন্ধ শুঁকে বা অল্প অল্প করে ফলের রস পান করে বমি বমি ভাব কমানো সম্ভব।

সঠিক আসন নির্বাচন

গাড়ির সিট
যেকোনো যানবাহনে ভ্রমণের সময় সঠিক আসন নির্বাচন করুন | Photo by Markus Winkler on Unsplash

যেকোনো যানবাহনে ভ্রমণের সময় মোশন সিকনেস কমানোর জন্য সঠিক আসন নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাড়িতে ভ্রমণের সময় সম্ভব হলে সবসময় সামনের আসনে বসার চেষ্টা করুন, বিশেষ করে চালকের পাশের আসনটি সবচেয়ে ভালো। এতে আপনি সরাসরি সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবেন, ফলে আপনার চোখ ও মস্তিষ্কের মধ্যে সংকেতের সমন্বয় বজায় থাকবে। 

জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য, বিশেষ করে কোনো স্থির বস্তুর দিকে বা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকাও খুব উপকারী। এতে মস্তিষ্কের বিভ্রান্তি কমে এবং বমিভাবের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। তবে বই পড়া, মোবাইল ফোন দেখা বা গাড়ির ভেতরের দিকে বেশি মনোযোগী না হওয়াই ভালো, কারণ এগুলো মোশন সিকনেস বাড়িয়ে দিতে পারে। 

নৌযানে ভ্রমণের সময় জাহাজের মাঝখানে বসার চেষ্টা করুন, কারণ ওই অংশে দুলুনি অপেক্ষাকৃত কম অনুভূত হয়। আর বিমানে ভ্রমণ করলে ডানার কাছের আসনে বসাই বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ এসব আসনে ঝাঁকুনি তুলনামূলকভাবে কম হয়।

সঠিক ভঙ্গি এবং পরিবেশ

বালিশ বা কুশন
ভ্রমনের সময় মাথার নিচে একটি বালিশ বা কুশন ব্যবহার করুন তাতে মাথা স্থির থাকবে | Photo by Connor McManus

ভ্রমণকালীন ভঙ্গি এবং চারপাশের পরিবেশও মোশন সিকনেস কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই ভ্রমণের সময় মাথাকে যতটা সম্ভব স্থির রাখার চেষ্টা করুন, কারণ অতিরিক্ত নড়াচড়া বা কাঁপুনি বমি ভাব বাড়াতে পারে। প্রয়োজনে মাথার নিচে একটি বালিশ বা কুশন ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে মাথা আরামদায়কভাবে স্থির থাকে। একইসঙ্গে, গাড়ির ভেতরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা জরুরি। গরম এবং অক্সিজেনের অভাব বমি ভাবকে তীব্র করে তোলে, তাই জানালা খুলে দিন অথবা এসি চালু রাখুন যাতে ভেতরে ঠান্ডা ও সতেজ বাতাস প্রবেশ করতে পারে। 

দুর্গন্ধ এড়িয়ে চলা মোশন সিকনেস কমানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তামাকের ধোঁয়া, গাড়ির তেল বা খাবারের কড়া গন্ধ মোশন সিকনেস বাড়াতে পারে। এই ধরনের গন্ধ এড়িয়ে চলুন এবং প্রয়োজনে হালকা সুগন্ধিযুক্ত রুম ফ্রেশনার ব্যবহার করতে পারেন, যা পরিবেশকে সতেজ রাখবে।

এ ছাড়া ভ্রমণকালে মানসিকভাবে শান্ত থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুশ্চিন্তা বা অতিরিক্ত উত্তেজনা মোশন সিকনেস বাড়িয়ে দেয়, তাই গান শুনে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করে বা অন্য কোনো পছন্দের উপায়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। বিশেষভাবে, গভীর শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ার ব্যায়াম এই সময়ে বেশ কার্যকর হতে পারে।

মোশন সিকনেস ব্যান্ড বা প্রেসার পয়েন্ট

মোশন সিকনেস ব্যান্ড
মোশন সিকনেস কমাতে, প্রেসার পয়েন্ট বা মোশন সিকনেস ব্যান্ড ব্যাবহার করতে পারেন

কিছু বিশেষ ধরনের ব্যান্ড এবং নির্দিষ্ট প্রেসার পয়েন্ট মোশন সিকনেস কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন, অ্যাকিউপ্রেশার ব্যান্ড – যা ফার্মেসিতে পাওয়া যায় – এটি মোশন সিকনেস কমানোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো “সি-ব্যান্ড” (Sea-Band), যা কব্জির ভেতরের দিকে একটি নির্দিষ্ট প্রেসার পয়েন্টে চাপ প্রয়োগ করে কাজ করে। এই পয়েন্টটি “নেই কুয়ান” (Nei-Kuan) নামে পরিচিত এবং গবেষণায় দেখা গেছে এটি বমি বমি ভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। যদি আপনার কাছে এ ধরনের কোনো ব্যান্ড না থাকে, তাহলে তর্জনী এবং মধ্যমা আঙুল দিয়ে নিজেই এই প্রেসার পয়েন্টে (কব্জি থেকে তিন আঙুল উপরে) বৃত্তাকারভাবে হালকা চাপ দিতে পারেন। এই সহজ পদ্ধতিটিও মোশন সিকনেস কমাতে সহায়ক হতে পারে।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?

ডাক্তার
ডাক্তারের পরামর্শ নিন | Photo by TopSphere Media on Unsplash

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মোশন সিকনেস ঘরোয়া উপায় দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে যদি লক্ষণগুলো গুরুতর হয়, যেমন – বারবার বমি হওয়া যা ডিহাইড্রেশনের কারণ হতে পারে, তীব্র মাথা ব্যথা বা অন্যান্য অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়া, গর্ভবতী নারী, ছোট শিশু বা অন্য কোনো অসুস্থতার জন্য ওষুধ গ্রহণকারী ব্যক্তিরা কোনো নতুন ওষুধ গ্রহণের আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করবেন।

মোশন সিকনেস একটি বিরক্তিকর সমস্যা হলেও, এর সমাধান রয়েছে। সঠিক প্রস্তুতি, কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা এবং প্রয়োজনে ঔষধের সাহায্য নিলে ভ্রমণের এই অস্বস্তি অনেকটাই কমে যায়। ভয় না পেয়ে উপরের উপায়গুলো অবলম্বন করুন এবং আপনার ভ্রমণকে আরও আনন্দময় করে তুলুন। মনে রাখবেন, প্রতিটি মানুষের শরীর ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাই আপনার জন্য কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে কার্যকর, তা খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগতে পারে। তবে ধৈর্য ধরে চেষ্টা করলে আপনি অবশ্যই মোশন সিকনেস থেকে মুক্তি পাবেন।

আপনার কি মোশন সিকনেস নিয়ে আরও কোনো প্রশ্ন আছে, অথবা আপনি কি আপনার নিজস্ব কোনো কার্যকর উপায় সম্পর্কে জানতে চান?

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments