কিভাবে স্ক্রিন টাইম কমাবেন? জেনেনিন কিছু কৌশল

অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম এর ফলে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পরে তাই স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন

বর্তমান যুগে স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট এবং টেলিভিশনের মতো ডিজিটাল ডিভাইসগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কাজ থেকে শুরু করে বিনোদন পর্যন্ত সব কিছুতেই স্ক্রিনের ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। চোখের সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত, মনোযোগের অভাব, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা – এগুলো সবই অতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহারের কুফল।

তবে, কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করে স্ক্রিন টাইমকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তাই আজকে আমরা তেমনই কিছু কার্যকর কৌশল সম্পর্কে জানব।

স্ক্রিন টাইম ট্র্যাক করুন

স্ক্রিন টাইম
স্ক্রিন টাইম ট্র্যাক করে আপনার ডিজিটাল ডিভাইসের সঠিক এবং ব্যবহার নিশ্চিত করুন

প্রথমেই, আপনাকে আপনার প্রতিদিনের স্ক্রিন ব্যবহারের সময় সম্পর্কে জানতে হবে। বর্তমানের স্মার্টফোন এবং অনেক ডিজিটাল ডিভাইসেই এই তথ্য ট্র্যাক করার জন্য বিল্ট-ইন ফিচার রয়েছে।

অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্য, “ডিজিটাল ওয়েলবিং” (Digital Wellbeing) একটি কার্যকর টুল। এটি আপনাকে দেখাবে আপনি কোন অ্যাপে প্রতিদিন কতটা সময় ব্যয় করছেন, কতবার আপনার ফোন আনলক করছেন এবং কতগুলো নোটিফিকেশন পাচ্ছেন। অন্যদিকে, আইওএস (iOS) ব্যবহারকারীদের জন্য, “স্ক্রিন টাইম” (Screen Time) একই ধরনের সুবিধা দেয়। এটি শুধুমাত্র আপনার ব্যবহারের প্যাটার্ন দেখাবে না, বরং অ্যাপ ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করতে, ডাউনটাইম শিডিউল করতে এবং নির্দিষ্ট অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ব্লক করতেও সাহায্য করবে।

একবার আপনি আপনার নিজস্ব ব্যবহারের প্যাটার্ন সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়ে গেলে, আপনি বুঝতে পারবেন আপনার ডিজিটাল অভ্যাসগুলো কেমন। এই ডেটার উপর ভিত্তি করে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে কোন অ্যাপে সময় কমানো প্রয়োজন অথবা কোন ডিজিটাল কার্যকলাপ আপনার জন্য উপকারী। 

আরও দেখুনঃ সকালবেলা এই ৫টি কাজ কখনোই করবেন না

স্ক্রিন ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করুন

স্ক্রিন ব্যবহারের সময়সীমা
স্ক্রিন টাইম কমানোর জন্য স্ক্রিন ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করুন

স্ক্রিন টাইম কমানোর জন্য আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনি প্রতিদিন সব মিলিয়ে মোট কতক্ষণ স্ক্রিন ব্যবহার করবেন। এই সময়সীমা নির্ধারণ করার সময় আপনার দৈনন্দিন কাজ, পড়াশোনা বা অফিসের প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যক্তিগত বিনোদনের সময়কে মাথায় রাখুন।

এরপর, প্রতিটি ডিভাইসের জন্য আলাদা আলাদা সময়সীমা নির্ধারণ করুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি মোবাইলের জন্য ২ ঘণ্টা, কম্পিউটারের জন্য ৪ ঘণ্টা, এবং ট্যাবলেটের জন্য ১ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখতে পারেন। এই কাজটি আপনাকে প্রতিটি ডিভাইসের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকতে সাহায্য করবে এবং কোন ডিভাইসে আপনি বেশি সময় ব্যয় করছেন তা সহজেই বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনে অ্যালার্ম বা রিমাইন্ডার ব্যবহার করতে পারেন যা আপনাকে স্ক্রিন ব্যবহারের সময়সীমা সম্পর্কে সচেতন করবে।

নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন

নোটিফিকেশন
অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ রাখাই ভালো

আমরা হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত, কিন্তু হঠাৎ একটি অপ্রয়োজনীয় অ্যাপের নোটিফিকেশন চোখে পড়তেই সেটি দেখার জন্য ফোন হাতে নিতে বাধ্য হই। এই অভ্যাস ধীরে ধীরে আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে এবং অকারণে ফোন ব্যবহারের সময় বাড়িয়ে দেয়।

এই সমস্যা থেকে বাঁচতে প্রথমেই অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন। অনেক অ্যাপ আছে যেগুলো নিয়মিত অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে বিরক্ত করে, সেগুলোর নোটিফিকেশন না এলেই ভালো। আর যেসব অ্যাপের নোটিফিকেশন গুরুত্বপূর্ণ, যেমন মেসেজ, ইমেইল বা ব্যাঙ্কিং অ্যাপ, সেগুলোর ক্ষেত্রেও একটি সময় নির্ধারণ করে নিন। প্রতিবার আসা মাত্রই দেখে ফেলার বদলে নির্দিষ্ট সময় নিয়ে নোটিফিকেশনগুলো দেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এতে করে আপনার মনোযোগ বারবার নষ্ট হবে না এবং স্ক্রিন টাইমও কমে আসবে।

ফোন নাগালের বাইরে রাখুন

কিভাবে স্ক্রিন টাইম কমাবেন?
বিশ্রাম নেওয়ার সময় ফোন দূরে কোথাও রাখুন | Photo by Radoslav Bali on Unsplash

যখন আপনি বিশ্রাম নিচ্ছেন, তখন ফোন আপনার থেকে দূরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এই সহজ অভ্যাসটি আপনার মানসিক শান্তি এবং পারিবারিক সম্পর্ককে উন্নত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাতের বেলা ঘুমানোর সময় ফোন বিছানার পাশে না রেখে অন্য কোথাও রাখা উচিত। এতে ঘুমের মান ভালো হয় এবং গভীর রাতে নোটিফিকেশন বা স্ক্রিনের আলোতে ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা থাকে না। 

একইভাবে, যখন আপনি পরিবারের সদস্যদের সাথে খাবার খাচ্ছেন অথবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন, তখন ফোনটি দূরে রাখুন। এতে সবার মধ্যে মনোযোগ বাড়ে, যোগাযোগ আরও কার্যকর হয় এবং একে অপরের প্রতি আরও বেশি সময় ও গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়।

অফলাইন শখের দিকে মনোযোগ দিন

বাগান করা
অবসর সময় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যাবহার না করে শখের কাজগুলো করুন | Image by Mariakray from Pixabay

অবসর সময় মানেই যে শুধু ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যাবহার করতে হবে তা নয়, বরং এটি হতে পারে নিজের পছন্দের কাজগুলো করার এক চমৎকার সুযোগ। প্রযুক্তির আধিপত্যপূর্ণ এই সময়ে আমরা অনেকেই অবসর পেলেই স্মার্টফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপে সময় কাটাই। কিন্তু আপনি চাইলে এই সময়টাকে আরও ভালভাবে ব্যবহার করতে পারেন। নিজের জন্য নতুন কোনো অফলাইন শখ গড়ে তুলুন কিংবা আগে যেসব শখ ছিল, সেগুলোতে আবার মনোযোগ দিন। যেমন – বাগান করা, ছবি আঁকা, লেখালেখি, খেলাধুলা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো কিংবা হাতের কাজ করা ইত্যাদি। 

এ ধরনের কাজগুলো শুধু যে আপনাকে স্ক্রিন থেকে দূরে রাখবে তাই নয়, বরং মানসিক প্রশান্তি, সৃজনশীলতা এবং আত্মতৃপ্তিও এনে দেবে। তাই প্রযুক্তির দুনিয়া থেকে কিছুটা সময় বের করে নিজের ভালোলাগার কাজগুলো করুন, যা আপনাকে আরো পরিপূর্ণ ও সুখী জীবন উপহার দিতে পারে।

স্ক্রিন-মুক্ত সময় তৈরি করুন

মেডিটেশন
মাঝে মাঝে একা সময় কাটাতে পারেন অথবা পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারেন এতে মস্তিষ্ক বিশ্রামের সুযোগ পাবে | Image by Benjamin Balazs from Pixabay

প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে স্ক্রিনের প্রতি আমাদের নির্ভরতা এতটাই বেড়ে গেছে যে আমরা প্রায় ভুলেই যাচ্ছি চোখ, মস্তিষ্ক এবং মন – এই তিনটির বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। তাই প্রতিদিন কিছু নির্দিষ্ট সময়কে ‘স্ক্রিন-মুক্ত সময়’ হিসেবে নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, সকালের নাস্তার সময়, দুপুরের খাবারের সময় কিংবা ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে আপনি যদি মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ বা টিভির মতো কোনো স্ক্রিন ব্যবহার না করেন, তাহলে আপনার মস্তিষ্ক এক ধরনের বিশ্রামের সুযোগ পায়। 

এই সময়গুলোতে আপনি নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারেন, বই পড়তে পারেন, বা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বসে থাকতেও পারেন। এভাবে প্রতিদিন সামান্য সময়ের স্ক্রিন বিরতি আপনাকে বাস্তব জীবনের সাথে আরও গভীরভাবে যুক্ত হতে সাহায্য করবে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে।

রাতে ফোন চার্জ দেওয়া এড়িয়ে চলুন

ফোন চার্জ হচ্ছে
বালিশের পাশে ফোন চার্জ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন | Photo by Amr Taha™ on Unsplash

ঘুমের সময় অনেকেই অভ্যাসবশত ফোনকে বালিশের পাশে বা হাতের নাগালের মধ্যে রেখে চার্জে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু এই অভ্যাসটি আপনার ঘুমের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে বা কোনো ধরনের নোটিফিকেশন এলে, আমরা প্রায়ই ফোনটি হাতে তুলে নিই এবং স্ক্রিনে চোখ রাখি। ফলে আবার ঘুমিয়ে পড়া কঠিন হয়ে যায় এবং ঘুমের মানও নষ্ট হয়। 

এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি কার্যকর উপায় হলো – ফোনটি নিজের ঘরের বাইরে, অন্য কোনো ঘরে চার্জে দেওয়া। এতে ফোনে নোটিফিকেশন এলেও আপনি সহজেই সেটিকে উপেক্ষা করতে পারবেন এবং ঘুমের সময় ফোন ব্যবহারের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।

সকালে ফোন দিয়ে দিন শুরু করা বন্ধ করুন

বিছানায় শুয়ে একজন মহিলা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন
সকালে উঠেই মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকবেন না | Photo by Marcus Aurelius

সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকের একটি সাধারণ অভ্যাস হলো মোবাইল ফোন চেক করা – নোটিফিকেশন দেখা, সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা কিংবা মেসেজ পড়া। এই অভ্যাসটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ দিনের শুরুতেই আমরা বাইরের জগতের চাপ এবং অপ্রয়োজনীয় উদ্বেগের মধ্যে ডুবে যাই। এর পরিবর্তে সকালের শুরুটা যদি একটু সচেতনভাবে করা যায়, তাহলে পুরো দিনটিই হতে পারে আরও ইতিবাচক ও উৎপাদনশীল। 

তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ মেডিটেশন করুন, হালকা ব্যায়াম করুন বা আপনার পছন্দের কোনো বই পড়ুন। এসব কাজ মনকে শান্ত করে, মনোযোগ বাড়ায় এবং একটি ফ্রেশ অনুভূতি নিয়ে দিন শুরু করার সুযোগ করে দেয়।

স্ক্রিন টাইম কমানো একটি ধীর প্রক্রিয়া। রাতারাতি এই অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ধৈর্য ধরুন এবং ছোট ছোট পদক্ষেপ নিন। মনে রাখবেন, সুস্থ জীবনযাপনের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ ডিজিটাল জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি কি অন্য কোনো কৌশল ব্যবহার করেন স্ক্রিন টাইম কমাতে? নিচে কমেন্ট করে জানান!

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments