কিভাবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলবেন?

কিভাবে গড়বেন সঠিক খাদ্যাভ্যাস? জেনে নিন সহজ কিছু নিয়মাবলী

আমরা সবাই সুস্থ থাকতে চাই, প্রাণবন্ত থাকতে চাই, আর এর মূল ভিত্তি কিন্তু লুকিয়ে আছে আমাদের খাবারের অভ্যাসের মধ্যে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন হয়তো যা খুশি তাই খেয়েছি। চকোলেট, ফাস্ট ফুড – এগুলো ছিল আমাদের পছন্দের শীর্ষে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের শরীর পরিবর্তন হয়, চাহিদা বদলায়। তখন যদি আমরা সেই আগের মতোই অনিয়ন্ত্রিত খাবার খেতে থাকি, তাহলে শরীরে বাসা বাঁধতে নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগ। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।

এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে আমরা এই সঠিক খাদ্যাভ্যাসটা তৈরি করবো? এটা কিন্তু একদিনে হওয়ার নয়, এটা গড়ে তোলার জন্য ধীরে ধীরে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। চলুন, সেই নিয়মগুলো একটু সহজ করে জেনে নেওয়া যাক

সময় মেনে খাবার গ্রহণ

সময় মেনে খাবার গ্রহণ করুন
প্রতিদিন সময়মতো খাবার গ্রহন করুন | Photo by Pablo Merchán Montes on Unsplash

যখন আমরা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খাই, তখন আমাদের পাচনতন্ত্র সেই অনুযায়ী অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে গ্যাস, অ্যাসিডিটি, ও পেটের সমস্যা অনেক কমে যায়। এছাড়া, সময়মতো খাওয়া রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শরীরে শক্তি ঠিকঠাক বজায় থাকে এবং ক্লান্তি বা দুর্বলতা সহজে আসে না। নিয়মিত খাবারের ফলে আমাদের ঘুমও ভালো হয়, মনোযোগ বাড়ে এবং ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকে। 

সাধারণত সকালে ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে নাস্তা, দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে দুপুরের খাবার, বিকেলে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে হালকা নাস্তা এবং রাত ৮টার আগেই রাতের খাবার খাওয়াই স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। তাই সুস্থ জীবন যাপন করতে চাইলে সময় মেনে খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

সুষম আহার গ্রহণ

সুষম আহার গ্রহণ
প্রতিদিন সুষম আহার গ্রহণ করুন | Image by Sławek from Pixabay

সুষম আহার গ্রহণ আমাদের সুস্থ জীবনের ভিত্তি। এর অর্থ হলো প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় শস্য, ডাল, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম এবং দুগ্ধজাতীয় খাবার সঠিক পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত করা। প্রতিটি খাদ্যগোষ্ঠী আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিন্ন ভিন্ন পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। 

শস্য এবং ডাল আমাদের শক্তি যোগায়, সবজি ও ফল ভিটামিন এবং খনিজ সরবরাহ করে রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মাছ, মাংস এবং ডিম প্রোটিনের উৎস, যা শরীরের গঠন ও মেরামতের জন্য অপরিহার্য। দুগ্ধজাত খাবার হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুষম আহার গ্রহণ কেবল শারীরিক সুস্থতাই নিশ্চিত করে না, এটি মানসিক স্বাস্থ্য এবং কর্মক্ষমতা বাড়াতেও সহায়ক।

প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি

প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি
প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি খান | Photo by engin akyurt on Unsplash

প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এগুলি ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিতে ভরপুর থাকে। নিয়মিত ফল ও সবজি খেলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিছু ধরণের ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। 

ফাইবার হজমক্ষমতাকে উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে। ফল ও সবজির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলি কম ক্যালোরিযুক্ত হওয়ায় ওজন নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক।

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান

এক গ্লাস পানি
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন | Photo by manu schwendener on Unsplash

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য। এটি কেবল তৃষ্ণা নিবারণ করে না, বরং আমাদের শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যকারিতা সচল রাখতেও সহায়ক। পানির অভাবে আমাদের শরীরে ডিহাইড্রেশন হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি, মাথাব্যথা, এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান করলে ত্বক ময়েশ্চারাইজড থাকে, হজমক্ষমতা বাড়ে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং কিডনির কার্যকারিতা উন্নত হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন অন্তত ২-৩ লিটার পানি পান করা উচিত, তবে আবহাওয়া এবং শারীরিক কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে এই পরিমাণ পরিবর্তিত হতে পারে।

ফাস্ট ফুড ও চিনি যুক্ত খাবার পরিহার

ফাস্ট ফুড ও চিনি যুক্ত খাবার
ফাস্ট ফুড ও চিনি যুক্ত খাবার পরিহার করুন | Photo by Igor Ovsyannykov

বর্তমান যুগে ফাস্ট ফুড ও চিনি যুক্ত খাবার মানুষের খাদ্য তালিকায় ব্যাপকভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এসব খাবার স্বাদে আকর্ষণীয় হলেও শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফাস্ট ফুডে প্রায়শই অতিরিক্ত চর্বি, লবণ এবং কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যা শরীরের ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। 

অপরদিকে, চিনি যুক্ত খাবার অতিরিক্ত গ্রহণে ডায়াবেটিস, দাঁতের ক্ষয় এবং হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব কারণেই সুস্থ জীবন যাপনের জন্য ফাস্ট ফুড ও অতিরিক্ত চিনি যুক্ত খাবার পরিহার করা জরুরি। তার পরিবর্তে ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত, যা শরীরকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখবে।

আরও দেখুনঃ সকালবেলা এই কাজগুলো কখনোই করবেন না

ধীরে ধীরে খাওয়া এবং ভালোভাবে চিবানো

একজন মানুষ খাবার গ্রহন করছেন
খাবার খাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করবেন না | Photo by Frederick Medina on Unsplash

অনেকেই খাবার তাড়াহুড়া করে খায়, যা হজমের সমস্যার অন্যতম কারণ। ধীরে খেলে মস্তিষ্ক সময় পায় পেট ভরার সংকেত পাঠাতে, ফলে অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকা যায়। এছাড়া ভালোভাবে চিবিয়ে খেলে খাবার ছোট ছোট অংশে ভেঙে যায়, যা হজমে সাহায্য করে এবং শরীর সহজে পুষ্টিগুণ গ্রহণ করতে পারে। এই অভ্যাস খাদ্যজনিত অসুস্থতা যেমন গ্যাস, বদহজম ও ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়। তাই সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিনের খাবার ধীরে ও মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।

লেবেল(label) দেখে খাবার কিনুন

খাবারের লেবেল
খাবার কেনার সময় অবশ্যই তার লেবেল দেখে কিনুন | Photo by YesMore Content on Unsplash

বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত খাবার পাওয়া যায়, যার অনেকগুলোতেই অতিরিক্ত চিনি, লবণ, ফ্যাট বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকতে পারে। তাই খাবার কেনার আগে অবশ্যই তার লেবেল বা মোড়কের তথ্য ভালোভাবে পড়া উচিত। লেবেলে উপাদান তালিকা, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, পুষ্টিগুণ, প্রিজারভেটিভস বা কৃত্রিম রঙ ব্যবহারের তথ্য থাকে, যা আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। 

একটি ছোট অভ্যাস—লেবেল দেখা—আমাদের অনেক বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই খাদ্যসচেতন হতে হলে লেবেল দেখে খাবার কেনা অভ্যাস করুন।

আসুন, এবার আমরা একটু দেখে নিই অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেকার কিছু মূল পার্থক্যঃ

বৈশিষ্ট্যঅনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসসঠিক খাদ্যাভ্যাস
খাবারের সময়অনিয়মিত এবং যখন খুশি তখন খাওয়ানির্দিষ্ট সময়ে খাবার গ্রহণ
খাবারের ধরণফাস্ট ফুড, চিনি যুক্ত খাবার, ভাজাভুজি বেশিসুষম আহার, ফল, সবজি ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ
পুষ্টি উপাদানপ্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অভাবশরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি
পানির পরিমাণঅপর্যাপ্ত পানি পানপর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান
খাবার গ্রহণের গতিতাড়াহুড়ো করে খাওয়াধীরে ধীরে খাওয়া এবং ভালোভাবে চিবানো
শরীরের উপর প্রভাবওজন বৃদ্ধি, হজমের সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসুস্থ শরীর, সঠিক ওজন, ভালো হজম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

সঠিক খাদ্যাভ্যাস আমাদের জীবনকে অনেক সুন্দর ও সুস্থ করতে পারে। এটা হয়তো একদিনে পরিবর্তন করা কঠিন, তবে ধীরে ধীরে চেষ্টা করলে অবশ্যই সম্ভব। নিজের শরীরের প্রতি একটু যত্ন নিন, সঠিক খাবার খান এবং সুস্থ থাকুন।

পরিশেষে একটাই কথা বলবো, “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল”। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে একটা সুন্দর ও সুস্থ জীবন গড়ি, সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে।

আপনার কোনো মতামত থাকলে অবশ্যই জানাবেন। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন!

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments