স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে?

জেনেনিন, স্টারলিংক কি? কিভাবে কাজ করে? এর সুবিধা কি?

স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে? এই নিয়ে আমাদের জানার আগ্রহের যেন কোনো কমতি নেই। আজকাল ইন্টারনেট আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের কাজ, পড়াশোনা, বিনোদন – প্রায় সবকিছুতেই বর্তমানে ইন্টারনেট লাগে। কিন্তু অনেক সময় আমরা এমন জায়গায় থাকি যেখানে ভালো ইন্টারনেটের সংযোগ পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বা প্রত্যন্ত এলাকায়। তাই, এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স (SpaceX)-এর একটি যুগান্তকারী প্রকল্প – স্টারলিংক (Starlink)। তাই আজকে আমরা স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

তাহলে চলুন, জেনে নেওয়া যাক স্টারলিংক এর বিষয়ে।

স্টারলিংক কী?

স্টারলিংক কী?
স্টারলিংক হল একটি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা | Image by freepik

স্টারলিংক হলো পৃথিবীর চারপাশে হাজার হাজার ছোট ছোট স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক। এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার উপরে, লো আর্থ অরবিটে (LEO) প্রদক্ষিণ করে। প্রচলিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সার্ভিসগুলোর স্যাটেলাইটগুলো প্রায় ৩৬,০০০ কিলোমিটার উপরে থাকে, যার ফলে ডেটা আসতে বেশি সময় লাগে এবং সিগন্যালের মান খারাপ হয়। স্টারলিংকের এই কম উচ্চতার স্যাটেলাইটগুলোই এর প্রধান সুবিধা। তাই, এক কথায় বলতে গেলে স্টারলিংক হল একটি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা।

আরও দেখুনঃ স্টারলিংকের রাউটার কতদূর পর্যন্ত কভারেজ দেয়?

স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে?

স্টারলিংক
স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে?

সহজভাবে বোঝার জন্য আমরা স্টারলিংকের কাজ করার প্রক্রিয়াকে কয়েকটি সহজ ভাগে ভাগ করতে পারি, যেমন –

স্যাটেলাইট কনস্টেলেশন

স্টারলিংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর বিশাল স্যাটেলাইট কনস্টেলেশন। স্পেসএক্স নিয়মিত তাদের শক্তিশালী রকেটের মাধ্যমে শত শত স্যাটেলাইট পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit – LEO) প্রেরণ করছে। এই স্যাটেলাইটগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত থেকে একটি বিশাল জালের মতো নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এই নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত যে এটি পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অংশকে কভার করতে পারে, এমনকি দুর্গম গ্রামীণ এলাকা বা সমুদ্রের মাঝখানেও ইন্টারনেট সরবরাহ করতে সক্ষম। এই স্যাটেলাইটগুলোর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যা স্টারলিংকের কভারেজ এবং সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।

স্টারলিংক কিট

স্টারলিংক পরিষেবা সাবস্ক্রাইব করার সময় একটি বিশেষ স্টারলিংক কিট সরবরাহ করা হয়। এই কিটে প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার থাকে যা আপনাকে স্টারলিংক স্যাটেলাইটের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। এগুলো হলো –

  • স্টারলিংক ডিশঃ এটি দেখতে অনেকটা ছোট থালার মতো এবং এটি আপনার বাড়ির ছাদের মতো খোলা জায়গায় স্থাপন করতে হয়। এটাকে “ডিস্কি” নামেও ডাকা হয়। এই ডিশটি অত্যন্ত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এবং এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাকাশে থাকা সবচেয়ে কাছের স্টারলিংক স্যাটেলাইটি খুঁজে বের করে তার সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং সেটি দূরে চলে গেলে তার পরেরটির সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এর স্মার্ট অ্যান্টেনা সিস্টেম নিশ্চিত করে যে এটি সর্বদা সবচেয়ে ভালো সিগন্যাল গ্রহণ করছে।
  • ওয়াইফাই রাউটারঃ এই রাউটারটি স্টারলিংক ডিশের মাধ্যমে আসা ইন্টারনেট সিগনালকে আপনার ডিভাইসে (যেমন—কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ইত্যাদি) ওয়াইফাই আকারে সরবরাহ করে। এটি আপনার বাড়ির মধ্যে একটি শক্তিশালী ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা আপনাকে নির্বিঘ্নে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে সাহায্য করে।
  • পাওয়ার সাপ্লাই এবং কেবলঃ ডিশ এবং রাউটার উভয়কেই পাওয়ার দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাওয়ার অ্যাডাপ্টার এবং ডেটা আদান-প্রদানের জন্য উপযুক্ত কেবল এই কিটের অন্তর্ভুক্ত থাকে।

ডেটা আদান-প্রদান

আপনি যখন আপনার কম্পিউটার বা ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন (যেমন—একটি ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা বা ভিডিও দেখা), তখন সেই ডেটা আপনার ওয়াইফাই রাউটারের মাধ্যমে স্টারলিংক ডিশে যায়। ডিশটি সেই ডেটা মহাকাশে থাকা সবচেয়ে কাছের স্টারলিংক স্যাটেলাইটে পাঠায়। এটি একটি অত্যন্ত দ্রুত প্রক্রিয়া, যা প্রায় আলোর গতিতে সম্পন্ন হয়। স্যাটেলাইটটি ডেটা গ্রহণ করে এবং সেটিকে পৃথিবীর কোনো নিকটবর্তী গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠায়।

এই গ্রাউন্ড স্টেশনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্থাপন করা আছে এবং এগুলি উচ্চ গতির ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত এবং এই সংযোগই ইন্টারনেটকে বাকি বিশ্বের সাথে যুক্ত করে। গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ডেটা ইন্টারনেটের মূল নেটওয়ার্কে পৌঁছে যায়, যেখানে আপনার অনুরোধটি পূরণ করা হয় (যেমন—আপনি যে ওয়েবসাইট দেখতে চেয়েছিলেন, তার সার্ভারে ডেটা পৌঁছায়)।

একইভাবে, ইন্টারনেট থেকে যখন কোনো ডেটা আপনার কাছে ফিরে আসে, তখন সেটি প্রথমে গ্রাউন্ড স্টেশনে আসে, সেখান থেকে স্যাটেলাইটে যায়, তারপর আপনার স্টারলিংক ডিশে আসে এবং সবশেষে আপনার ওয়াইফাই রাউটারের মাধ্যমে আপনার ডিভাইসে পৌঁছায়। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়।

কম উচ্চতা এবং দ্রুত গতি

স্টারলিংক কিট
স্টারলিংক কিভাবে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দেয়

স্টারলিংকের একটি অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো এর স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর পৃষ্ঠের অনেক কাছাকাছি (প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার) অবস্থান করে। এই কম উচ্চতার কারণে ডেটা সিগনালকে অনেক কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এর ফলে ডেটা আদান-প্রদানের সময় বা ল্যাটেন্সি (latency) অনেক কম হয়। ল্যাটেন্সি যত কম হবে, ইন্টারনেট গতি তত বেশি হবে।

স্টারলিংকের কম ল্যাটেন্সি প্রায় ফাইবার অপটিক ইন্টারনেটের মতোই দ্রুতগতির ইন্টারনেট অভিজ্ঞতা দেয়। এটি ভিডিও কল, অনলাইন গেমিং বা লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ডেটা প্রবাহে সামান্যতম বিলম্বও ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে। স্টারলিংক হাই ব্যান্ডউইথ এবং লো-ল্যাটেন্সি উভয়ই সরবরাহ করে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও উচ্চ-মানের ইন্টারনেট পরিষেবাকে সহজ করে দেয়।

স্টারলিংকের সুবিধা কী?

স্টারলিংকের সুবিধা কী?
স্টারলিংক কি কি সুবিধা প্রদান করে?
  • দ্রুত গতির ইন্টারনেটঃ বিশেষ করে যেখানে ফাইবার অপটিক পৌঁছায় না, সেখানে স্টারলিংক অবিশ্বাস্য গতি সরবরাহ করে।
  • কম ল্যাটেন্সিঃ কম উচ্চতার স্যাটেলাইটের কারণে ডেটা আদান-প্রদানে সময় কম লাগে, যা অনলাইন কার্যকলাপকে স্মুথ করে তোলে।
  • সর্বত্র প্রাপ্যতাঃ পৃথিবীর প্রায় সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দিতে সক্ষম।
  • সহজ সেটআপঃ স্টারলিংক কিট সেটআপ করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ।

স্টারলিংক কেবল একটি ইন্টারনেট সার্ভিস নয়, এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা ইন্টারনেটকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। যারা এতদিন লো লেটেন্সি এবং দ্রত গতির ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে ভুগছিলেন, তাদের জন্য স্টারলিংক একটি সত্যিকারের গেম চেঞ্জার। এছাড়া আপনি এটিকে যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন যা সত্যিই একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য।

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments