মহাকাশে ভেসে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (International Space Station – ISS) থেকে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখাটা একটি জটিল প্রক্রিয়া। কিন্তু, মহাকাশচারীরা কীভাবে আমাদের সাথে নিয়মিত কথা বলেন, ডেটা পাঠান এবং ছবি শেয়ার করেন, তা নিয়ে কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
চলুন, এই অসাধারণ প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে যোগাযোগ

মহাকাশ স্টেশন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (International Space Station – ISS), পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য প্রধানত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (Radio Frequency) ব্যবহার করে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এমন এক ধরনের তরঙ্গ যা বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় শক্তির মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। আপনি যেমন মোবাইল ফোনে কথা বলেন বা রেডিও শুনেন, ISS-ও অনেকটা একই প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ করে, তবে এটি অনেক বেশি উন্নত ও প্রযুক্তিগতভাবে জটিল পদ্ধতি।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) এ থাকে শক্তিশালী ট্রান্সমিটার (Transmitter) এবং রিসিভার (Receiver), যা কণ্ঠস্বর, ভিডিও, টেলিমেট্রি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ডেটাকে রেডিও তরঙ্গে রূপান্তর করে। এরপর এই তরঙ্গগুলি মহাকাশের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। একইভাবে পৃথিবী থেকেও রেডিও সিগন্যাল পাঠানো হয় মহাকাশ স্টেশনে।
আরও দেখুনঃ টেসলা কয়েল কি? টেসলা কয়েল কিভাবে কাজ করে?
অ্যান্টেনা ও গ্রাউন্ড স্টেশনগুলির ব্যবহার

ISS-এ বিভিন্ন ধরনের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টেনা রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশন বা স্থলভিত্তিক কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। এই গ্রাউন্ড স্টেশনগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে এবং NASA (National Aeronautics and Space Administration) সহ অন্যান্য মহাকাশ সংস্থার দ্বারা পরিচালিত হয়, যেমন রাশিয়ার Roscosmos।
গ্রাউন্ড স্টেশনগুলি একটি জালের মতো কাজ করে – যেখানে একাধিক স্টেশন একত্রে কাজ করে ISS-এর পাঠানো রেডিও সিগন্যাল গ্রহণ করে, সেগুলিকে প্রক্রিয়াজাত করে এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য পৃথিবীর বিভিন্ন সিস্টেমে পৌঁছে দেয়। আবার পৃথিবী থেকেও কমান্ড বা তথ্য মহাকাশ স্টেশনে পাঠানো হয় এই গ্রাউন্ড স্টেশনগুলোর মাধ্যমে।
স্যাটেলাইট রিলে ব্যবস্থা – TDRSS

যেহেতু আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতি ৯০ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, তাই এটি সবসময় পৃথিবীর নির্দিষ্ট কোনো গ্রাউন্ড স্টেশনের আওতায় থাকে না। অনেক সময় এমন হয় যে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) পৃথিবীর এমন স্থানে থাকে যেখান থেকে সরাসরি গ্রাউন্ড স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য ব্যবহার করা হয় Tracking and Data Relay Satellite System (TDRSS) নামক এক উন্নত স্যাটেলাইট রিলে সিস্টেম।
TDRSS হলো NASA পরিচালিত একাধিক স্যাটেলাইটের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিস্টেম, যেগুলো ভূ-সমলয় কক্ষপথে (Geosynchronous Orbit) অবস্থান করে। এই স্যাটেলাইটগুলি ISS থেকে প্রেরিত রেডিও সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং তা পৃথিবীর নির্দিষ্ট গ্রাউন্ড স্টেশনে রিলে (Relay) করে দেয়।
এর ফলে ISS পৃথিবীর যেকোনো স্থানে থাকলেও, TDRSS-এর মাধ্যমে প্রায় সার্বক্ষণিক (Near-continuous) যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে করে মহাকাশচারীদের সঙ্গে পৃথিবীর সংযোগ কখনোই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয় না।
যোগাযোগের ধরন

মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া, যা মূলত তিনটি প্রধান মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে –
ভয়েস যোগাযোগ
ভয়েস যোগাযোগের মাধ্যমে মহাকাশচারীরা নিয়মিতভাবে Ground Control-এর সঙ্গে কথা বলেন। এর মাধ্যমে তারা মিশনের অগ্রগতি, বিভিন্ন কার্যক্রম ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। শুধু তাই নয়, একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার জন্যও তারা এই যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন। এমনকি অনেক সময় তাদের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়, যাতে তারা মানসিকভাবে ভালো থাকেন এবং কাজের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন।
ডেটা ট্রান্সমিশন
ডেটা ট্রান্সমিশন হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যার মাধ্যমে মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ডেটা, সিস্টেমের কার্যকারিতা সংক্রান্ত তথ্য, পরিবেশগত পরিবর্তনের পরিমাপক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠানো হয়। এই ডেটাগুলো পৃথিবীর গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ভিডিও এবং ছবি
ভিডিও এবং ছবি পাঠানোর মাধ্যমটি আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে দৃশ্যমান ও আকর্ষণীয়। মহাকাশ থেকে তোলা অসাধারণ এবং মনোমুগ্ধকর ছবি ও ভিডিও নিয়মিতভাবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়, যেগুলো আমরা টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা বিভিন্ন মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে দেখতে পাই। এগুলো শুধু আমাদের মহাকাশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ায় না, বরং মহাকাশবিজ্ঞান ও মহাকাশ অভিযানের গুরুত্বকেও নতুন মাত্রায় তুলে ধরে। এই তিন ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয়ে মহাকাশ স্টেশন ও পৃথিবীর মধ্যে এক অবিচ্ছিন্ন ও কার্যকর সংযোগ বজায় থাকে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান

মহাকাশে থেকে পৃথিবীতে যোগাযোগ স্থাপন করা সহজ নয়। মহাকাশের কঠিন ও বৈরী পরিবেশ, তীব্র বিকিরণ, এবং যোগাযোগের পথে থাকা বাধা – যেমন পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডল ও আবহাওয়ার পরিবর্তন – এসব বিষয় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে।
এই সমস্ত চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করতে হলে অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি এবং জটিল সুরক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডেটা এনক্রিপশন (Data Encryption) ব্যবহার করা হয়, যা ডেটাকে গোপন করে রাখে এবং অননুমোদিত প্রবেশ থেকে রক্ষা করে। তাছাড়া, Error-Correction Code ব্যবহারের মাধ্যমে যেকোনো তথ্য আদান-প্রদানে যদি কোনো ত্রুটি ঘটে, তাহলে সেই ত্রুটিগুলো শনাক্ত করে ঠিক করার ব্যবস্থা থাকে, যাতে তথ্য সঠিকভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা মানবজাতির প্রকৌশল এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার এক দারুণ উদাহরণ। এটি মহাকাশ গবেষণায় অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য এবং ভবিষ্যতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
মহাকাশ নিয়ে আপনার কি আরও কিছু জানার আছে? আমদের কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!