ছারপোকা যদি একবার ঘরে ঢুকে পড়ে, তাহলে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। বিশেষ করে রাতের বেলা ঘুমের সময় এদের কামড় আমাদের বিশ্রাম ও স্বস্তিকে নষ্ট করে দেয়। ছারপোকা তাড়াতে বাজারে নানা ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক পাওয়া গেলেও, সেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক সময় আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই অনেকেই ঘরোয়া ও প্রাকৃতিক উপায়ে ছারপোকা দমন করতে চান।
তাহলে চলুন, দেখে নেয়া যাক ছারপোকা তাড়ানোর ১০টি ঘরোয়া উপায়
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
গরম পানি ও রোদে শুকানো

ছারপোকা এবং তার ডিম ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা তার বেশি তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে না। তাই, ছারপোকা দূর করতে আপনার বিছানার চাদর, তোশক কভার এবং বালিশের কভার ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপে গরম পানিতে ধুয়ে ফেলুন। আপনার ওয়াশিং মেশিনে যদি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অপশন থাকে, তাহলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নির্বাচন করুন। যদি না থাকে, তাহলে কাপড় গরম পানি দিয়ে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে তারপর স্বাভাবিকভাবে ধুয়ে নিতে পারেন।
ধোয়ার পর, ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিন। সূর্যের তীব্র আলো এবং তাপ ছারপোকা দমনে অতিরিক্ত সহায়তা করবে। নিশ্চিত করুন যে কাপড়গুলো সম্পূর্ণ শুকিয়েছে, কারণ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ছত্রাক জন্মাতে পারে। যদি সম্ভব হয়, আপনার তোশক এবং সোফাও ৪-৫ ঘণ্টা সরাসরি রোদে রেখে দিন। সূর্যের আলো ছারপোকা এবং তাদের ডিমকে ধ্বংস করতে সাহায্য করবে।
রোদে তোশক বা সোফা রেখে একটি বড় পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিন, এতে ভেতরের তাপমাত্রা আরও বাড়বে।
আরও দেখুনঃ সময় বাঁচানোর জন্য প্রতিদিনের ৫টি দারুণ হ্যাকস
ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার

ছারপোকা তাড়াতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে ঘরের প্রতিটি কোণা, বিছানার সমস্ত ফাঁক, সোফার গ্যাপ এবং কার্পেট অত্যন্ত ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। মনে রাখবেন, শুধুমাত্র বড় ছারপোকা নয়, তাদের ডিম এবং লার্ভাও অপসারণ করা জরুরি। তাই, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহারের সময় বিশেষ মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি স্থান পরিষ্কার করুন। ভ্যাকুয়াম করার পর ভ্যাকুয়াম ব্যাগটি সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিন অথবা পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলুন। যদি ভ্যাকুয়াম ব্যাগটি ধ্বংস করা না হয়, তাহলে ছারপোকাগুলো আবার ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাবে।
তাই, কমপক্ষে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন বা একদিন পর পর ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করে পরিষ্কার করুন। নিয়মিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনিং ছারপোকার উপদ্রব কমাতে এবং আপনার বাড়িকে ছারপোকামুক্ত রাখতে সাহায্য করবে।
বেকিং সোডা

বেকিং সোডা ছারপোকার শরীরের আর্দ্রতা শুষে নিয়ে তাদের মেরে ফেলে। এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করার জন্য, আপনাকে ছারপোকার আনাগোনার সম্ভাব্য সব জায়গায় বেকিং সোডা ছিটিয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে বিছানার চারপাশে, তোষকের নিচে, খাটের ফাটলে, দেয়ালের ফাটলে, আসবাবপত্রের কোণায় এবং যেখানে ছারপোকা দেখা যেতে পারে এমন সব স্থানে বেকিং সোডার একটি পাতলা স্তর ছড়িয়ে দিন।
বেকিং সোডা ছিটিয়ে দেওয়ার পর, এটি অন্তত কয়েক ঘণ্টা (২৪ ঘণ্টা) রেখে দিন যাতে এটি ছারপোকার সংস্পর্শে আসে এবং কার্যকর হতে পারে। এরপর, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করে ছিটিয়ে দেওয়া বেকিং সোডা এবং মরা ছারপোকা পরিষ্কার করে ফেলুন। এটি প্রতিদিন পরিষ্কার করে নতুন করে বেকিং সোডা ছিটিয়ে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিতভাবে এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে গেলে ছারপোকার উপদ্রব ধীরে ধীরে কমে আসবে।
ভিনেগার স্প্রে

ভিনেগারের তীব্র গন্ধ ছারপোকা একেবারেই সহ্য করতে পারে না, যা তাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। এই অস্বস্তি তাদের দুর্বল করে তোলে এবং এক পর্যায়ে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করে। বিশেষ করে অ্যাপল সিডার ভিনেগার এক্ষেত্রে বেশ উপকারী।
ছারপোকা তাড়ানোর জন্য সমপরিমাণ অ্যাপল সিডার ভিনেগার এবং পানি ভালোভাবে মিশিয়ে একটি স্প্রে বোতলে ভরে নেওয়া। এরপর ছারপোকার সম্ভাব্য আবাসস্থলগুলোতে এই মিশ্রণটি স্প্রে করতে হবে। নিয়মিত এই ভিনেগার মিশ্রণ স্প্রে করার মাধ্যমে ছারপোকার উপদ্রব উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। ভিনেগারের প্রাকৃতিক উপাদান হওয়ায় এটি রাসায়নিক কীটনাশকের মতো ক্ষতিকর নয়, যা ঘরের পরিবেশে ব্যবহার করার জন্য নিরাপদ।
লবঙ্গ ও নেফথালিন

ছারপোকা তাড়ানোর জন্য লবঙ্গ এবং নেফথালিনের তীব্র গন্ধ খুবই কার্যকর। কিছু লবঙ্গ একটি পাতলা কাপড়ে অথবা ছোট ছোট পুঁটলিতে বেঁধে নিতে পারেন। এরপর এই লবঙ্গের পুঁটলিগুলো ছারপোকার উপদ্রব আছে এমন সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে রেখে দিন। যেমন: বিছানার কোণায়, তোশকের নিচে, সোফার ভাঁজে অথবা আলমারির তাকে। লবঙ্গের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ছারপোকাকে সেই স্থান থেকে পালাতে বাধ্য করবে।
একইভাবে, নেফথালিন বল বা ন্যাপথলিন ছারপোকা তাড়ানোর জন্য বেশ পরিচিত। নেফথালিনের শক্তিশালী গন্ধ ছারপোকার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আপনি এই নেফথালিন বলগুলো বিছানার নিচে, আলমারির ভেতরে, সোফার কোণায়, ড্রয়ারের মধ্যে অথবা যেখানে ছারপোকা লুকিয়ে থাকতে পারে এমন সব জায়গায় ছড়িয়ে দিন। এই দুটি জিনিসের নিয়মিত ব্যবহারে আপনি আপনার ঘরকে ছারপোকা মুক্ত রাখতে পারবেন।
টি-ট্রি অয়েল বা ল্যাভেন্ডার অয়েল

টি-ট্রি অয়েল বা ল্যাভেন্ডার অয়েল, উভয়ই প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক হিসেবে পরিচিত এবং আশ্চর্যজনকভাবে ছারপোকা দমনেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এর শক্তিশালী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিসেপটিক গুণাবলী ছারপোকা এবং তাদের ডিমের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা ছারপোকার বংশবিস্তার রোধে সাহায্য করে।
এই প্রাকৃতিক উপাদানটি ব্যবহার করতে, আপনি ১৫-২০ ফোঁটা টি-ট্রি অয়েল (অথবা ল্যাভেন্ডার অয়েল) এক কাপ পানির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে একটি স্প্রে বোতলে ভরুন। এরপর এই মিশ্রণটি আপনার বাড়ির বিভিন্ন স্থানে, যেখানে ছারপোকার উপদ্রব বেশি দেখা যায়, সেখানে নিয়মিত স্প্রে করুন। নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি ছারপোকার উপদ্রব কমাতে এবং ধীরে ধীরে তাদের নির্মূল করতে পারবেন।
পুদিনা পাতা বা পুদিনার তেল

প্রথমে কিছু তাজা পুদিনা পাতা সংগ্রহ করুন। এরপর এই পাতাগুলোকে ভালোভাবে থেঁতো করে নিন যাতে পুদিনার তীব্র গন্ধ ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। থেঁতো করা এই পুদিনা পাতাগুলো সরাসরি আপনার বিছানা, তোশক, খাটের কোণায়, ফার্নিচারের ফাটলে অথবা যেখানে ছারপোকার উপদ্রব বেশি বলে মনে হয়, সেখানে রেখে দিন।
এছাড়াও, আপনি পুদিনার এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে, কয়েক ফোঁটা পুদিনার এসেনশিয়াল অয়েল পানির সাথে মিশিয়ে একটি স্প্রে বোতলে ভরে নিন। এরপর এই মিশ্রণটি ছারপোকা আক্রান্ত স্থানে নিয়মিত স্প্রে করুন। পুদিনার প্রাকৃতিক উপাদান ছারপোকাকে তাড়াতে সাহায্য করবে এবং আপনার ঘরকে ছারপোকা মুক্ত রাখতে সহায়তা করবে।
নিম পাতা বা নিম তেল

প্রথমে, পর্যাপ্ত পরিমাণে নিম পাতা সংগ্রহ করুন। এই পাতাগুলো ভালো করে ধুয়ে একটি পাত্রে রেখে, তাতে পরিমাণ মতো পানি যোগ করে সেদ্ধ করুন। পানি ফুটে পাতার নির্যাস বেরিয়ে আসার পর, মিশ্রণটি ঠান্ডা হতে দিন। ঠান্ডা হয়ে গেলে, এই পানি একটি স্প্রে বোতলে ভরে নিন। এরপর, ছারপোকা যেখানে বেশি দেখা যায় সেই সমস্ত আড্ডাস্থানে ভালোভাবে স্প্রে করুন।
এছাড়া, নিম তেলের ব্যবহার আরও সহজ এবং কার্যকর হতে পারে। একটি স্প্রে বোতলে সমপরিমাণ নিম তেল এবং পানি মিশিয়ে নিন। নিম তেলের তীব্র গন্ধ এবং এর প্রাকৃতিক কীটনাশক গুণ ছারপোকা দমনে খুবই কার্যকর। এই মিশ্রণটি ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিন যাতে তেল ও পানি ভালোভাবে মিশে যায়। এরপর, পূর্বের মতো ছারপোকার সম্ভাব্য আশ্রয়স্থলগুলোতে এই মিশ্রণটি স্প্রে করুন।
আয়রন বা স্টিম ক্লিনার ব্যবহার করুন

আপনার তোশক, সোফা এবং কার্পেটের মতো আসবাবপত্র থেকে ছারপোকা দূর করতে একটি স্টিম ক্লিনার ব্যবহার করতে পারেন। স্টিম ক্লিনারের সাহায্যে ছারপোকার আবাসস্থলে সরাসরি গরম বাষ্প প্রয়োগ করুন। বাষ্পের উচ্চ তাপমাত্রা ছারপোকা এবং তাদের ডিমের প্রোটিন বিকৃত করে দেয়, যার ফলে তারা মারা যায়। স্টিম ক্লিনার ব্যবহার করার সময় খেয়াল রাখবেন যেন আসবাবপত্রের প্রতিটি কোণায় এবং ফাটলে বাষ্প পৌঁছায়, কারণ ছারপোকা এসব গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকে।
এছাড়াও, বিছানার চাদর, বালিশের কভার এবং অন্যান্য কাপড় থেকে ছারপোকা দূর করতে গরম আয়রন ব্যবহার করা যেতে পারে। উচ্চ তাপ ছারপোকা এবং তাদের ডিমকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবে। এই পদ্ধতিটি নিয়মিত অনুসরণ করলে ছারপোকার উপদ্রব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে এবং আপনার বাড়ি ছারপোকামুক্ত রাখতে সাহায্য করবে।
ডায়াটোমেসিয়াস আর্থ

এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর প্রাকৃতিক সাদা পাউডার যা ছারপোকা দমনে বিশেষভাবে সহায়ক। এর কার্যপ্রণালী হলো ছারপোকার শরীর থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে তাদের মেরে ফেলা। এই পাউডার ছারপোকার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দেয় এবং তাদের ডিহাইড্রেশনের মাধ্যমে নির্মূল করে। যেহেতু এটি প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, তাই এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এবং রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছারপোকা দমনের জন্য, প্রথমে তাদের চলাচলের পথ এবং যেসব স্থানে তারা লুকিয়ে থাকে সেগুলো চিহ্নিত করুন। এরপর এই পাউডারটি চিহ্নিত স্থানগুলোতে ভালোভাবে ছিটিয়ে দিন। পাউডারটি ছারপোকার সংস্পর্শে আসার সাথে সাথেই কাজ শুরু করবে। পাউডার ছিটানোর ২-৩ দিন পর স্থানটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন এবং পুনরায় পাউডার ছিটিয়ে দিন। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করলে ছারপোকার উপদ্রব সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ছারপোকা ছোট হলেও এর বিরক্তি অনেক বড়। তবে কিছু সচেতনতা ও ঘরোয়া প্রতিকার মেনে চললে আপনি সহজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। যেকোনো সমাধানে ধৈর্য ধরুন এবং নিয়মিতভাবে এগুলো অনুসরণ করুন। আপনার যদি নিজস্ব কোনো ঘরোয়া টিপস থাকে ছারপোকা তাড়ানোর, তাহলে অবশ্যই নিচে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।