আপনি কি জানেন, পৃথিবীর বুকে এমন কিছু দেশ আছে যেখানে সুখ যেন নিত্যদিনের সঙ্গী? যেখানে প্রতিটি ভোর হয় হাসিমুখে, আর প্রতিটি সূর্যাস্ত নিয়ে আসে এক নতুন দিনের স্বপ্ন? প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট (World Happiness Report) প্রকাশিত হয়, যা আমাদের জানায় পৃথিবীর কোন দেশগুলো তাদের নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি সুখ দিতে সক্ষম। এই রিপোর্টটি মূলত ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোর সুখের মাত্রা পরিমাপ করে – মাথাপিছু জিডিপি, সামাজিক সহায়তা, সুস্থ জীবন প্রত্যাশা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, উদারতা এবং দুর্নীতি উপলব্ধি।
তাই, আজকে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ১০টি দেশ সম্পর্কে জানব এবং দেখব কেন এই দেশগুলো বারবার সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
ফিনল্যান্ড

দীর্ঘদিন ধরে ফিনল্যান্ড ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, এর পেছনের রহস্য কী?
ফিনল্যান্ডের নাগরিকরা তাদের সরকারের ওপর অত্যন্ত আস্থাশীল। দেশটিতে উচ্চমানের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিনামূল্যে শিক্ষা, চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিষ্কার বাতাস, হাজার হাজার হ্রদ এবং সাওনা সংস্কৃতির জনপ্রিয়তাও তাদের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করে তোলে। এছাড়াও, দেশটিতে দুর্নীতির মাত্রা অত্যন্ত কম, যা নাগরিকদের মধ্যে আস্থা এবং নিরাপত্তা তৈরি করে।
আরও দেখুনঃ পৃথিবীর সুন্দর ১০টি জায়গা – আপনি কি জানেন এগুলো কোথায়?
ডেনমার্ক

ডেনমার্কও সুখী দেশের তালিকায় নিয়মিত উপরের দিকে থাকে। ডেনিশদের ‘হুগা’ (Hygge) নামক একটি জীবনদর্শন আছে, যা সহজভাবে বলতে গেলে আরামদায়ক এবং স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি করে আনন্দ খুঁজে বের করা। এটি কেবল একটি শব্দ নয়, এটি একটি জীবনযাত্রা।
ডেনমার্কে শক্তিশালী সামাজিক সহায়তা ব্যবস্থা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা, এবং একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি রয়েছে। সরকার নাগরিকদের উচ্চ জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করে। ডেনমার্কের মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মান এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য গর্বিত। তাদের কর্ম-জীবনের ভারসাম্যও প্রশংসনীয়, যেখানে পরিবার এবং ব্যক্তিগত সময়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আইসল্যান্ড

আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ছোট কিন্তু শক্তিশালী সম্প্রদায় এবং উচ্চ সামাজিক সংহতি আইসল্যান্ডকে বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে। আইসল্যান্ডের মানুষ একে অপরের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং বিপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। দেশটিতে অপরাধের হার অত্যন্ত কম, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত, এবং নারীরা সমাজে উচ্চ স্থান অধিকার করে।
ভূতাপীয় শক্তি এবং প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণগুলি তাদের জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতায় অবদান রাখে। আইসল্যান্ডের জনগণ প্রকৃতিকে সম্মান করে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় সচেষ্ট। কঠিন আবহাওয়া সত্ত্বেও, তাদের মধ্যে একটি ইতিবাচক মনোভাব এবং মানসিক দৃঢ়তা দেখা যায়।
সুইডেন

সুইডেন একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, যেখানে নাগরিকদের জন্য উচ্চমানের সামাজিক সুবিধা, বিনামূল্যে শিক্ষা, এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। সুইডেনের মানুষ তাদের সরকারের ওপর আস্থা রাখে এবং সমাজে উচ্চ মাত্রার বিশ্বাস বিদ্যমান।
দেশটিতে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং কর্ম-জীবনের ভারসাম্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুইডিশদের ‘ফিগা’ (Fika) নামক একটি সংস্কৃতি আছে, যার অর্থ কফি বিরতি। এটি কেবল কফি পান করা নয়, বরং সহকর্মী বা বন্ধুদের সাথে একত্রিত হয়ে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার একটি উপায়। এটি তাদের সামাজিক সংযোগ এবং মানসিক সুস্থতায় অবদান রাখে।
ইজরায়েল

সম্প্রতি ইজরায়েল সুখী দেশের তালিকায় উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছে। যদিও এটি একটি অপ্রত্যাশিত নাম মনে হতে পারে, তবে ইজরায়েলের জনগণ তাদের সম্প্রদায়গত সংহতি, শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার মানসিকতার জন্য পরিচিত।
তাদের মধ্যে জীবনের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা এবং আনন্দ বিদ্যমান। উচ্চ প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবেও ইজরায়েল পরিচিত, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সহায়তা করে। যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতা মাঝে মাঝে দেখা যায়, তবে অভ্যন্তরীণভাবে তাদের সামাজিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ তাদের সুখের একটি বড় কারণ।
নেদারল্যান্ডস

নেদারল্যান্ডস তার উদার সামাজিক নীতি, সাইকেল চালানোর সংস্কৃতি এবং সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য পরিচিত। ডাচরা তাদের জীবনযাত্রায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে কাজ, পরিবার এবং ব্যক্তিগত সময়কে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
নেদারল্যান্ডসে একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিনামূল্যে শিক্ষা, এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে। ডাচদের মধ্যে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং সহনশীলতা দেখা যায়, যা একটি শান্তিপূর্ণ এবং সুখী সমাজ তৈরি করে। শিশুদের সুখের দিক থেকেও নেদারল্যান্ডস প্রায়শই শীর্ষস্থানে থাকে, যা উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা এবং খেলার সুযোগের কারণে সম্ভব হয়।
নরওয়ে

প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নরওয়েকে পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে। নরওয়ের নাগরিকরা উচ্চ জীবনযাত্রার মান, বিনামূল্যে শিক্ষা, এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা উপভোগ করে।
দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যেমন – ফিয়র্ড (fjords) এবং পর্বতমালা, তাদের মানসিক শান্তিতে অবদান রাখে। নরওয়ের মানুষ প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসে এবং আউটডোর কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। দেশটির সরকারের ওপর মানুষের উচ্চ আস্থা এবং দুর্নীতির নিম্ন হারও তাদের সুখের একটি বড় কারণ।
সুইজারল্যান্ড

সুইজারল্যান্ড তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্থিতিশীল অর্থনীতি এবং উচ্চ জীবনযাত্রার মানের জন্য সুপরিচিত। সুইজারল্যান্ডের নাগরিকরা উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা, চমৎকার শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা উপভোগ করে। দেশটিতে সরাসরি গণতন্ত্রের চর্চা হয়, যেখানে নাগরিকরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি অংশ নিতে পারে, যা তাদের মধ্যে ক্ষমতায়নের অনুভূতি তৈরি করে।
সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতা এবং শান্তিপ্রিয় মনোভাবও তাদের সুখের একটি কারণ। সুন্দর পর্বতমালা, পরিষ্কার হ্রদ এবং নির্মল বাতাস তাদের জীবনকে আরও আনন্দময় করে তোলে। দেশটির মানুষের মধ্যে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং দায়িত্বশীল মনোভাব দেখা যায়, যা একটি সুসংগঠিত সমাজ তৈরি করে।
লুক্সেমবার্গ

লুক্সেমবার্গ একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত সমৃদ্ধ দেশ। এর উচ্চ মাথাপিছু জিডিপি এটিকে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। এই আর্থিক সমৃদ্ধি নাগরিকদের উচ্চ জীবনযাত্রার মান, চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা এবং উন্নত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
লুক্সেমবার্গে কর্মসংস্থানের হার বেশি এবং কাজের পরিবেশও বেশ ভালো। যদিও এটি একটি ছোট দেশ, তবে এর বহুসংস্কৃতির পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব এটিকে একটি অনন্য স্থান দিয়েছে। নিরাপদ পরিবেশ এবং কম অপরাধের হারও নাগরিকদের মধ্যে স্বস্তি ও নিরাপত্তা তৈরি করে, যা তাদের সুখের একটি বড় কারণ।
নিউজিল্যান্ড

নিউজিল্যান্ড তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষের জন্য পরিচিত। নিউজিল্যান্ডের নাগরিকরা শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন, প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসের সুযোগ এবং একটি সুস্থ জীবনধারা উপভোগ করে। দেশটি পরিবেশ সুরক্ষায় অত্যন্ত সচেষ্ট এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।
নিউজিল্যান্ডের সরকারের ওপর মানুষের উচ্চ আস্থা এবং দুর্নীতির হারও কম যা তাদের সুখের বিশেষ একটি কারণ। দেশটির সংস্কৃতিতে ‘কিয়া ওরা’ (Kia Ora) অর্থাৎ ‘শুভেচ্ছা’ এবং ‘সুস্বাস্থ্য’ এর মতো মূল্যবোধগুলো বেশ জনপ্রিয়, যা সামাজিক সংহতিকে আরও দৃঢ় করে। কোলাহলমুক্ত জীবন, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা এবং এক ধরনের সামাজিক সাম্য এই দেশের মানুষকে সুখী করে তোলে।
এই দেশগুলো কেবল উন্নত অর্থনীতিই নয়, বরং তাদের নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক সম্পর্ক এবং মানসিক সুস্থতার প্রতিও গুরুত্ব দেয়। তারা প্রমাণ করে যে প্রকৃত সুখ কেবল আর্থিক প্রাচুর্যের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি আসে একটি সুস্থ সমাজ, সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি থেকে।