সময়! এক অমূল্য সম্পদ যা আমাদের সবার কাছে সীমিত এবং যার অভাব আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। মনে হয় যেন দিনগুলো চোখের পলকে ছুটে পালাচ্ছে, আর আমরা যেন সবসময়ই সময়ের পেছনে ছুটছি। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা আমাদের এমন এক চক্রে ফেলে দিয়েছে যেখানে সময় বাঁচানো একটি অপরিহার্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মজীবনের চাপ, পারিবারিক দায়িত্ব, সামাজিক দায়বদ্ধতা – সবকিছুর ভিড়ে নিজেদের জন্য সময় বের করা যেন এক দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু যদি এমন কিছু সহজ এবং কার্যকরী উপায় থাকে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিছুটা সময় বাঁচিয়ে দিতে পারে, তাহলে কেমন হয়?
চলুন, দেখে নেওয়া যাক সময় বাঁচানোর জন্য ৫টি দারুণ হ্যাকস যা আপনার জীবনকে আরও সহজ করে তুলবে।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
১. সকালে দিনের পরিকল্পনা করুন

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই দিনের শুরুটা করুন একটি ছোট্ট অথচ কার্যকরী পরিকল্পনার মাধ্যমে। এই অভ্যাসটি আপনার সময়কে সুসংগঠিত করতে এবং প্রতিটি কাজকে দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে। দিনের শুরুতে কাজের একটি সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন কোন কাজগুলো আপনার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটি কম গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য আপনি একটি ছোট নোটবুক ব্যবহার করতে পারেন, যেখানে দিনের প্রয়োজনীয় কাজগুলো লিখে রাখবেন। অথবা, আপনার স্মার্টফোনের রিমাইন্ডার অ্যাপটিও ব্যবহার করতে পারেন, যা আপনাকে সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট কাজগুলোর কথা একটি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে মনে করিয়ে দেবে।
এই কাজটির মূল উদ্দেশ্য হলো কাজের একটি সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করা। কোন কাজটা আগে করবেন, কোনটি পরে, সেটার একটি সঠিক পরিকল্পনা থাকলে আপনার মস্তিষ্ক অপ্রয়োজনীয় চিন্তা বা দ্বিধায় জড়াবে না। ফলে আপনি প্রতিটি কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন এবং কাজগুলোও দ্রুত শেষ হবে। এই অভ্যাসটি আপনাকে কেবল টাইম ম্যানেজমেন্ট এ দক্ষ করে তুলবে না, বরং আপনার মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করবে, কারণ আপনি জানতে পারবেন দিনের শেষে আপনি কী কী কাজ সম্পন্ন করেছেন কি করা উচিৎ হয়নি এবং কি করা উচিৎ ছিল।
আরও দেখুনঃ সকালবেলা এই ৫টি কাজ কখনোই করবেন না
২. অপ্রয়োজনীয় স্ক্রিন টাইম কমান

আমরা প্রায় সকলেই দিনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের স্মার্টফোন, ল্যাপটপ অথবা টেলিভিশন স্ক্রিনের পেছনে ব্যয় করি। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে স্ক্রল করা, অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও দেখতে থাকা – এই অভ্যাসগুলো আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে দেয়। এই ডিজিটাল আসক্তি আমাদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই, এই ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে বাস্তব জীবনে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
শুধুমাত্র প্রয়োজনের ভিত্তিতেই ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার করুন। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো, যেমন পড়াশোনা, অফিসের কাজ অথবা পারিবারিক দায়িত্ব, শেষ করে তারপর বিনোদনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করুন। এছাড়া, নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা, ঘুমানোর আগে ডিভাইস ব্যবহার না করা, এবং নির্দিষ্ট সময় পরে ব্রেক নেওয়াও এই ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর হতে পারে। মনে রাখবেন, স্ক্রিন টাইম কমানো মানে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল ডিভাইস ত্যাগ করা নয়, বরং এর সঠিক এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। আপনি আপনার ডিভাইস ব্যাবহার করুন আপনার ডিভাইস যেন আপনাকে ব্যাবহার না করে।
৩. মাল্টিটাস্কিং নয়, সিঙ্গেল-টাস্কিং করুন

অনেকের মনে এই ভুল ধারণা বাসা বেঁধে আছে যে, একসাথে একাধিক কাজ বা মাল্টিটাস্কিং করলে বুঝি সময় বাঁচে। তাঁরা মনে করেন, যখন একটি কাজ করতে করতে বিরক্তি চলে আসে, তখন অন্য একটি কাজে হাত দিলে নাকি সময়টা আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, মাল্টিটাস্কিং আসলে আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে দেয় এবং কাজের দক্ষতা ও মান কমিয়ে দেয়।
যখন আমরা একসাথে অনেকগুলো কাজ করার চেষ্টা করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ককে দ্রুত এক কাজ থেকে অন্য কাজে স্থানান্তরিত হতে হয়। এই বারবার স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যার ফলে প্রতিটি কাজে আমাদের মনোযোগ কমে যায়। এর পরিণতিতে, কাজগুলো ধীর গতিতে সম্পন্ন হয় এবং তাতে ভুল হওয়ার প্রবণতাও অনেক বেড়ে যায়। অনেকটা জগাখিচুড়ি পাকানোর মতো, যেখানে কোনো কিছুই নিখুঁতভাবে তৈরি হয় না।
এর পরিবর্তে, সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মাত্র কাজে মনোযোগ দেওয়া। একটি কাজ হাতে নিন এবং সেটিকে সম্পূর্ণরূপে শেষ করার পরই অন্য কোনো কাজে হাত দিন। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে আপনার মনোযোগ অবিচল থাকবে এবং কাজটি দ্রুত ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হবে।
৪. ছোট ছোট কাজগুলো দ্রুত সেরে ফেলুন

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক ছোট ছোট কাজ থাকে যা সম্পন্ন করতে খুব বেশি সময় লাগে না। যেমন, একটি ইমেলের দ্রুত উত্তর দেওয়া, বিদ্যুৎ বা পানির বিল পরিশোধ করা, অথবা একটি সংক্ষিপ্ত ফোন কল সেরে ফেলা। এই ধরনের কাজগুলো প্রায়শই আমরা অবহেলা করে ফেলে রাখি, এই ভেবে যে “পরে করে নেব”। কিন্তু এই মানসিকতা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। যখনই আপনার হাতে পাঁচ-দশ মিনিটের মতো বাড়তি সময় আসে – হতে পারে আপনি কফির বিরতিতে আছেন, বাসে যাতায়াত করছেন, অথবা কোনো মিটিং শুরুর আগে একটু অপেক্ষা করছেন – তখনই এই ছোট কাজগুলো সেরে ফেলার চেষ্টা করুন।
এই কাজগুলো জমিয়ে রাখলে সেগুলো একটি বিশাল পাহাড়ের মতো মনে হতে পারে, যা আপনার ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। একটি অসমাপ্ত ইমেলের চিন্তা, বা বিল পরিশোধের শেষ তারিখ ঘনিয়ে আসার উদ্বেগ আপনার মনকে অস্থির করে তুলতে পারে। অন্যদিকে, যখন আপনি সুযোগ পেলেই এই ছোট কাজগুলো চটজলদি সেরে ফেলেন, তখন আপনার কাজের তালিকা থেকে একটির পর একটি আইটেম বাদ পড়তে থাকে।
৫. ঘুমানোর আগে পরের দিনের প্রস্তুতি নিন

পরের দিনের জন্য রাতের বেলায় কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে সকালের মূল্যবান সময়কে আপনি আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারবেন। ধরুন, পরদিন কী পোশাক পরবেন, তা যদি আগের রাতেই ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রাখেন, তাহলে সকালে পোশাক খোঁজা বা ইস্ত্রি করার পেছনে সময় নষ্ট হবে না। একইভাবে, অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা ল্যাপটপসহ অফিসের ব্যাগটি যদি রাতে গুছিয়ে রাখেন, তাহলে সকালে তাড়াহুড়ো করে কিছু ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
বাচ্চাদের স্কুলের টিফিন বক্স এবং জলের বোতল রাতে প্রস্তুত করে রাখলে সকালে তাদের স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতি অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। অনেক সময় মায়েরা এই কাজটি করতে গিয়ে সকালে বেশ চাপের মধ্যে থাকেন। রাতে যদি টিফিন বক্সের জন্য শুকনো খাবার যেমন বিস্কুট, বাদাম, বা ফল কেটে রাখা যায়, তাহলে সকালে শুধু তা বক্সে ভরে দিলেই কাজ শেষ। এছাড়া, সকালে তৈরি করার মতো কোনো খাবার যদি থাকে, তার প্রাথমিক প্রস্তুতি যেমন সবজি কেটে রাখা বা মশলা পাউডার তৈরি করে রাখা যেতে পারে। এই ধরনের ছোট ছোট প্রস্তুতিগুলো আপনার সকালের রুটিনকে অনেক বেশি সুন্দর করে তুলবে। ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো কিছু নিয়ে অস্থিরতা বা দৌড়ঝাঁপ করার প্রয়োজন হয় না।
সময় বাঁচানো মানে শুধু কাজের গতি বাড়ানো নয়, বরং জীবনকে আরও উপভোগ করার জন্য নিজেকে কিছুটা বাড়তি সময় দেওয়া। এই হ্যাকসগুলো আপনার দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করে দেখুন, আশা করি আপনিও এর সুফল পাবেন!