উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো খাবেন?

জেনেনিন কোন খাবারগুলো উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে!

আপনি কি জানেন উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো খাবেন? কোন খাবার উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে? আজকাল উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটিকে “নীরব ঘাতক” বলা হয়, কারণ এর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকলেও এটি দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউরের মতো মারাত্মক জটিলতার কারণ হতে পারে। ওষুধপত্রের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক খাবার নির্বাচন করে আপনি আপনার রক্তচাপের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারেন এবং সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন

চলুন জেনে নেওয়া যাক, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে আপনার খাদ্যতালিকায় কোন খাবারগুলো যুক্ত করা উচিত

পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার

পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাই উচ্চ রক্তচাপ কমাতে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান | Photo by Filipp Romanovski on Unsplash

শরীরের সুস্থ কার্যকারিতার জন্য পটাশিয়াম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পটাশিয়াম শরীরের অতিরিক্ত সোডিয়াম দূর করতে সাহায্য করে, যা উচ্চ রক্তচাপের একটি প্রধান কারণ। সোডিয়ামের মাত্রা বেশি হলে রক্তনালী সংকুচিত হয় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। পটাশিয়াম এই প্রভাবকে প্রতিহত করে রক্তনালী শিথিল করতে সাহায্য করে, ফলে রক্তচাপ কমে আসে। তাই যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন অথবা এটি প্রতিরোধ করতে চান, তাদের খাদ্যতালিকায় পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যোগ করতে পারেন।

আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পটাশিয়ামের পরিমাণ বাড়াতে আপনি বিভিন্ন ধরণের খাবার যোগ করতে পারেন। সবুজ শাকসবজি পটাশিয়ামের চমৎকার উৎস। এর মধ্যে রয়েছে পালং শাক, লাউ, শসা, টমেটো, বাঁধাকপি, কুমড়া, মটরশুঁটি, কলমি শাক, এবং ফুলকপি। এই সবজিগুলো কেবল পটাশিয়ামই নয়, অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজও সরবরাহ করে।

ফলও পটাশিয়ামের একটি ভালো উৎস। কলা পটাশিয়ামের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়াও ডাবের পানি, আমলকি, নাশপাতি, পেঁপে, বেদানা, পেয়ারা, আঙুর, স্ট্রবেরি, এবং ব্লুবেরি আপনার খাদ্যতালিকায় পটাশিয়াম যোগ করার জন্য দারুণ বিকল্প হতে পারে। এছাড়াও, কিছু অন্যান্য খাবারও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ। এর মধ্যে ডাল, ডিম, মিষ্টি আলু, এবং অ্যাভোকাডো উল্লেখযোগ্য।

আরও দেখুনঃ উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো খাওয়া উচিত নয়?

উচ্চ রক্তচাপ কমাতে গোটা শস্য খেতে পারেন

ওটস
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার দেছে নিন | Image by Lars Beulke from Pixabay

সাদা চাল ও আটার মতো প্রক্রিয়াজাত শস্যের পরিবর্তে লাল চালের ভাত এবং লাল আটার রুটি বেছে নেওয়া আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে। কারণ, প্রক্রিয়াবিহীন গোটা শস্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। এই ফাইবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু রক্তচাপ কমাতেই সাহায্য করে না, বরং হজম প্রক্রিয়াকেও উন্নত করে এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে, যা অতিরিক্ত ওজন কমাতেও সহায়ক।

এছাড়াও, আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ওটস এবং বার্লি যোগ করা যেতে পারে। এই শস্যগুলোতেও প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত গোটা শস্য গ্রহণ করলে তা ডায়াবেটিস এবং কিছু নির্দিষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতেও অবদান রাখতে পারে।

কম চর্বিযুক্ত ও দুগ্ধজাত পণ্য

কম চর্বিযুক্ত ও দুগ্ধজাত পণ্য
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর সাথে সাথে দুগ্ধজাত খাবার আপনার হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ | Photo by Anita Jankovic on Unsplash

আপনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ কম চর্বিযুক্ত দুধ, টক দই, বা স্কিমড মিল্ক পান করতে পারেন। এই দুগ্ধজাত পণ্যগুলো আপনার হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

পাশাপাশি, আপনার খাদ্যতালিকায় চর্বিহীন প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত করা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর। এক্ষেত্রে, তৈলাক্ত মাছের পরিবর্তে ছোট মাছ যেমন – পুঁটি, মলা, বা কাচকি মাছ বেছে নিতে পারেন। এই মাছগুলোতে উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকলেও, অতিরিক্ত চর্বি এড়ানো যায়। মাংসের ক্ষেত্রে, মুরগির বুকের মাংস অথবা চর্বিবিহীন মাংস সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। এই ধরণের মাংস থেকে আপনি পর্যাপ্ত প্রোটিন পাবেন যা পেশী গঠনে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। 

এছাড়াও, শিম, বিনস এবং বিভিন্ন ধরনের ডাল হলো উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের চমৎকার উৎস। এগুলিতে ফাইবারও প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। এই ধরনের প্রোটিন উৎসগুলি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরাসরি সাহায্য করে এবং হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে অবদান রাখে।

বিট ও বেদানার রস

বিট
বিট ও বেদানার রস হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে | Photo by Polina Tankilevitch

নাইট্রেট সমৃদ্ধ বিট আপনার রক্তচাপ কমাতে দারুণ সহায়ক। এই নাইট্রেটগুলো রক্তনালীকে শিথিল করে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। এর ফলে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ কমে আসে। আপনি বিটের রস পান করতে পারেন অথবা সালাদে বা অন্যান্য খাবারে রান্না করা বিট যোগ করে খেতে পারেন।

বেদানার রস আপনার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরেকটি চমৎকার বিকল্প। এতে থাকা শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানগুলো রক্তচাপের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং রক্ত চলাচল স্বাভাবিক ও সচল রাখে। নিয়মিত বেদানার রস পান করা সামগ্রিক হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে।

বাদাম ও বীজ

বাদাম ও বীজ
বাদাম ও বীজ জাতীয় কিছু খাবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত উপকারী | Photo by Maddi Bazzocco on Unsplash

তিসি, বাদাম এবং সূর্যমুখী বীজ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত উপকারী, তবে মনে রাখতে হবে এগুলো পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা জরুরি। এই বীজগুলোতে থাকা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, ফাইবার এবং ম্যাগনেসিয়াম রক্তনালীকে শিথিল করতে এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। যেমন, তিসিতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও সহায়ক। একইভাবে, বাদাম এবং সূর্যমুখী বীজে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের প্রদাহ কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

রক্তচাপ কমাতে রসুন ও পেঁয়াজও বেশ কার্যকর। রসুনে থাকা অ্যালিসিন নামক উপাদান রক্তনালীকে প্রসারিত করে এবং ধমনী ও শিরায় জমে থাকা কোলেস্টেরল গলাতে সাহায্য করে, যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে বিশেষভাবে সহায়ক। নিয়মিত রসুন সেবন করলে রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। অন্যদিকে, পেঁয়াজে থাকা অ্যাডেনোসিন নামক যৌগ পেশী শিথিল করতে সাহায্য করে, যার ফলে রক্তনালীর চাপ কমে আসে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কাঁচা পেঁয়াজ বা এর রস খাওয়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী হতে পারে।

পর্যাপ্ত পানি পান করা

এক গ্লাস পানি
পানি রক্তকে পাতলা রাখতে সাহায্য করে তাই উচ্চ রক্তচাপ কমাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন | Photo by manu schwendener on Unsplash

শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যাবশ্যক, এবং এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন আপনি পর্যাপ্ত পানি পান করেন, তখন আপনার শরীর তার পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। এই ভারসাম্য বজায় থাকলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা প্রতিরোধ হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডিহাইড্রেশন হলে শরীরের রক্তনালীগুলো সংকুচিত হতে পারে, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। পর্যাপ্ত পানি রক্তকে পাতলা রাখতে সাহায্য করে, যা রক্তনালীগুলোর মধ্য দিয়ে রক্তের প্রবাহ সহজ করে তোলে এবং হৃদপিণ্ডের উপর চাপ কমায়। তাই, নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করে আপনি কেবল ডিহাইড্রেশনই প্রতিরোধ করছেন না, বরং আপনার রক্তচাপকেও স্বাভাবিক রাখতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছেন, যা দীর্ঘমেয়াদী হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে আপনি একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। 

মনে রাখবেন, যেকোনো নতুন খাদ্যতালিকা শুরু করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। আপনার স্বাস্থ্য আপনার হাতেই!
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments