বর্ষাকাল মানেই একদিকে যেমন রোম্যান্টিক বৃষ্টি আর সতেজ প্রকৃতির হাতছানি, তেমনই অন্যদিকে পেটের নানারকম সমস্যার আনাগোনা। এই সময়ে আমাদের হজমশক্তি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে অস্বস্তি, পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। বাইরে ভেজা আবহাওয়া, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এবং জীবাণুর দ্রুত বংশবৃদ্ধি – সব মিলিয়েই এই ঋতুতে পেটের স্বাস্থ্য নিয়ে একটু বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। কিন্তু ঘাবড়ানোর কিছু নেই! কিছু নির্দিষ্ট খাবার আপনার পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং বর্ষার অস্বস্তি কমাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, এই সময়ে কী কী খাবার আপনার খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত, যা আপনাকে সুস্থ ও সতেজ রাখতে সাহায্য করবে।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
দই বা টক দই

দই, বিশেষ করে টক দই, হলো প্রোবায়োটিকের একটি চমৎকার উৎস। এতে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা ‘গুড ব্যাকটেরিয়া’ আমাদের অন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং হজম প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্ষার সময় যখন হজমশক্তি দুর্বল থাকে, তখন দই এই উপকারী ব্যাকটেরিয়া সরবরাহ করে অন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায়। প্রতিদিন এক বাটি তাজা চিনি ছাড়া টক দই খেলে পেটের গোলমাল অনেকটাই কমে যায়, বদহজম দূর হয় এবং পেট ফাঁপার মতো সমস্যা থেকেও মুক্তি মেলে। যারা দুগ্ধজাত পণ্য হজম করতে পারেন না, তারা ল্যাক্টোজ-মুক্ত দই বা নারকেলের দুধ থেকে তৈরি দই বেছে নিতে পারেন।
আরও দেখুনঃ উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো খাবেন?
আদা

আদা শুধু চায়ে স্বাদই বাড়ায় না, এটি একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক হজম সহায়ক। এর মধ্যে থাকা জিঞ্জেরল নামক উপাদানটি অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণাবলীতে ভরপুর, যা বমি বমি ভাব, পেট ব্যথা, এবং হজমের অস্বস্তি কমাতে দারুণ কার্যকর। বর্ষায় সর্দি-কাশির প্রবণতাও বাড়ে, আর আদা এই দুটো সমস্যাতেই দারুণ কাজ করে। এক কাপ আদা চা সকালবেলা বা খাবারের পর পান করলে পেটের সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। তরকারিতে বা স্যুপে অল্প আদা যোগ করেও এর উপকারিতা পেতে পারেন।
কলা

কলা একটি সহজলভ্য এবং অত্যন্ত উপকারী ফল, যা পেটের স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ কাজ করে। এটি পটাশিয়ামের একটি ভালো উৎস, যা শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যখন ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে লবণ ও খনিজ পদার্থ বেরিয়ে যায়। কলায় থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং অন্ত্রের চলাচল স্বাভাবিক রাখে। এটি হজম করাও খুব সহজ, তাই পেটের সমস্যা থাকলে বা দুর্বল লাগলে কলা একটি আদর্শ খাবার। দিনে এক বা দুটি কলা খেলে আপনার পেট শান্ত থাকবে এবং প্রয়োজনীয় শক্তিও মিলবে।
হালকা ও সহজে হজমযোগ্য খাবার

বর্ষার সময় আমাদের হজমতন্ত্র এমনিতেই কিছুটা ধীর গতিতে কাজ করে। তাই এই সময়ে গুরুপাক খাবার, অর্থাৎ অতিরিক্ত তেল-মশলাযুক্ত বা ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এর পরিবর্তে এমন খাবার বেছে নিন যা হজম করা সহজ এবং পেটের ওপর চাপ কম ফেলে। খিচুড়ি (বিশেষ করে মুগ ডালের খিচুড়ি), ডালিয়া, সেদ্ধ সবজি (যেমনঃ লাউ, ঝিঙে, পটল), পাতলা মুগ ডাল, বা ওটস – এই ধরনের খাবারগুলো আপনার হজমতন্ত্রকে বিশ্রাম দেবে এবং পেটের অস্বস্তি কমাবে। এগুলো কম তেলে বা পানি দিয়ে রান্না করে খান।
পর্যাপ্ত পানি পান

বৃষ্টির দিনে বাইরে ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকে বলে অনেক সময় পিপাসা কম লাগে। কিন্তু বর্ষাকালেও পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি। পানি শরীরকে আর্দ্র রাখে, টক্সিন বের করে দেয় এবং হজম প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে সাহায্য করে। ডিহাইড্রেশন বা পানির অভাবে কোষ্ঠকাঠিন্যসহ নানা রকম পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে অবশ্যই মনে রাখবেন, ফুটিয়ে ঠান্ডা করা পানি অথবা ফিল্টার করা পানি পান করবেন। বাইরের পানি বা অস্বাস্থ্যকর পানি পান করলে পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই, দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন।
তাজা ফল ও সবজি

মৌসুমী তাজা ফল এবং সবজি আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করুন। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবার থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং হজমশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। তবে ফল ও সবজি খাওয়ার আগে অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন, কারণ বর্ষায় জীবাণুর সংক্রমণ বেশি হয়। পেঁপে, আপেল, শসা, লাউ, ঝিঙে, পটল, কুমড়ো – এই ধরনের ফল ও সবজিগুলো হজম করা সহজ এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর।
ভেষজ চা

কিছু ভেষজ চা পেটের অস্বস্তি কমাতে অসাধারণ কাজ করে। তুলসী চা, পুদিনা চা, বা ক্যামোমাইল চা – এই ভেষজগুলো পেটের ব্যথা, ফোলাভাব, এবং গ্যাস কমাতে বেশ কার্যকর। তুলসীর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল গুণাবলী পেটের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। পুদিনা হজম প্রক্রিয়াকে শান্ত করে এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমায়। ক্যামোমাইল চা তার শান্তিদায়ক প্রভাবের জন্য পরিচিত, যা পেটের পেশী শিথিল করতে এবং ক্র্যাম্প কমাতে সাহায্য করে। দিনে একবার বা দুবার এই ধরনের চা পান করলে আপনি আরাম অনুভব করবেন।
কিছু সতর্কতা
- বর্ষায় রাস্তার খোলা খাবার, ফুচকা, চাট বা জাঙ্ক ফুড পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন। এগুলোতে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।
- কাঁচা সালাদ বা খোলা রাখা কাটা ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। সম্ভব হলে সবজি সেদ্ধ করে খান।
- বাসি খাবার বা আগের দিনের রান্না করা খাবার একদমই খাবেন না। সব সময় টাটকা রান্না করা খাবার খান।
- খাওয়ার আগে ও পরে হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিন।
এই বর্ষায় উল্লেখিত খাবারগুলো আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে পেটের সমস্যাকে বিদায় জানান এবং সুস্থ থাকুন! এই সহজ টিপসগুলো মেনে চললে আপনার বর্ষাকাল কাটুক আনন্দময় এবং স্বাস্থ্যকর।
এই বর্ষায় আপনার পেটের সুস্থতা নিশ্চিত করতে আর কোনো প্রশ্ন আছে কি?