আকাশে দীর্ঘতম পথ পাড়ি দেওয়া ফ্লাইটগুলো সবসময়ই আমাদের কৌতূহল জাগায়। একটানা ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হাজার হাজার মাইল উড়ে যাওয়া এই ফ্লাইটগুলো শুধুমাত্র প্রকৌশল এবং লজিস্টিকেরই এক অসাধারণ নিদর্শন নয়, বরং যাত্রীদের জন্যও এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু আপনি কি জানেন বিশ্বের দীর্ঘতম ফ্লাইট কোনগুলো এবং কেনই বা এগুলো এত দীর্ঘ?
চলুন, জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের দীর্ঘতম কিছু ফ্লাইট সম্পর্কে।
এই নিবন্ধে যা যা থাকছে
বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম কিছু ফ্লাইট

দীর্ঘতম ফ্লাইটের বিষয়টি নির্ধারণ করা হয় মূলত দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে – দূরত্ব (নটিক্যাল মাইল বা কিলোমিটার) এবং সময়কাল (ঘণ্টা)। তবে, বাতাসের গতিপথ (জেটস্ট্রিম), আবহাওয়া এবং অন্যান্য কারণের ওপর নির্ভর করে একই ফ্লাইটের সময়কাল ভিন্ন হতে পারে। এখানে বিশ্বের দীর্ঘতম কিছু ফ্লাইটের তালিকা দেওয়া হলো, যা দূরত্ব এবং সময়কালের দিক থেকে শীর্ষস্থানে রয়েছে।
আরও দেখুনঃ মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীতে কিভাবে যোগাযোগ করে জানেন কি?
সিঙ্গাপুর থেকে নিউ ইয়র্ক (JFK) – সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স (SQ24)
এটি বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম বাণিজ্যিক ফ্লাইট। এই ফ্লাইটটি প্রায় ১৫,৩৪৫ কিলোমিটার (৯,৫৩৪ মাইল) পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ১৮ থেকে ১৯ ঘণ্টা সময় নেয়। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এই ফ্লাইটটি এয়ারবাস A350-900ULR (Ultra Long Range) দিয়ে পরিচালিত হয়, যা দীর্ঘ যাত্রার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর থেকে নিউ ইয়র্ক(EWR) – সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স (SQ22)
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের আরেকটি দীর্ঘ ফ্লাইট এটি, যা নিউ ইয়র্কের নিউইয়র্ক লিবার্টি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। দূরত্ব প্রায় ১৫,৩৪৩ কিলোমিটার (৯,৫৩৩ মাইল) এবং সময়কাল প্রায় ১৮ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট।
দোহা থেকে অকল্যান্ড – কাতার এয়ারওয়েজ (QR920)
এই ফ্লাইটটি প্রায় ১৪,৫৩০ কিলোমিটার (৯,০৩২ মাইল) দূরত্ব অতিক্রম করে এবং সময় নেয় প্রায় ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা। কাতার এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার এই রুটে চলাচল করে।
পার্থ(Perth) থেকে লন্ডন – কুয়ান্টাস এয়ারওয়েজ (QF9)
অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী এই ফ্লাইটটি প্রায় ১৪,৪৮৯ কিলোমিটার (৮,৯৯১ মাইল) পথ পাড়ি দেয়। সময় লাগে প্রায় ১৭ ঘণ্টা ২০ মিনিট। এটি কুয়ান্টাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম ফ্লাইটগুলোর মধ্যে অন্যতম।
অকল্যান্ড থেকে দুবাই – এমিরেটস (EK449)
নিউজিল্যান্ড থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত পর্যন্ত বিস্তৃত এই ফ্লাইটটি প্রায় ১৪,২১০ কিলোমিটার (৮,৮২৯ মাইল) দীর্ঘ এবং সময় লাগে প্রায় ১৭ ঘণ্টা।
দীর্ঘতম ফ্লাইটের পেছনের কারণ

প্রথমত, ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংযোগ একটি বড় কারণ। এই দীর্ঘ ফ্লাইটগুলো সাধারণত দুটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র কিংবা জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে, যেখানে যাত্রীদের সরাসরি ফ্লাইটের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। এর ফলে যাত্রীরা ট্রানজিট ঝামেলা এড়াতে পারেন এবং মূল্যবান সময় বাঁচে।
দ্বিতীয়ত, বিমান প্রযুক্তির অগ্রগতি এই দীর্ঘ ফ্লাইটগুলোকে বাস্তবায়নযোগ্য করেছে। আধুনিক বিমান যেমন এয়ারবাস A350-900ULR এবং বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারে রয়েছে উন্নত জ্বালানি দক্ষতা এবং দীর্ঘ পাল্লার সক্ষমতা, যা এত দীর্ঘ পথ একটানা অতিক্রম করার সুবিধা দেয়।
তৃতীয়ত, যাত্রীদের সুবিধাও এই ফ্লাইটগুলোর জনপ্রিয়তার একটি কারণ। সরাসরি ফ্লাইট যাত্রীদের জন্য অনেক বেশি আরামদায়ক, কারণ এতে সময় ও পরিশ্রম উভয়ই কমে যায়, বিশেষ করে ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীরা কিংবা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে আগ্রহী পর্যটকদের জন্য।
দীর্ঘ ফ্লাইটের চ্যালেঞ্জ এবং আরাম

দীর্ঘ ফ্লাইটে ভ্রমণ করা যাত্রীদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা হতে পারে। একাধিক টাইম জোন অতিক্রম করার ফলে জেট ল্যাগ একটি সাধারণ সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়, যা শরীরের স্বাভাবিক ঘুমচক্র ব্যাহত করে। দীর্ঘ সময় ধরে একই জায়গায় বসে থাকার কারণে ক্লান্তি, পেশী ব্যথা এবং রক্ত সঞ্চালনের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
এসব সমস্যাকে লাঘব করার জন্য এয়ারলাইন্সগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। আধুনিক কেবিন ডিজাইনের মাধ্যমে যাত্রীদের জন্য আরও আরামদায়ক আসন, পর্যাপ্ত লেগরুম এবং উন্নত বিনোদন ব্যবস্থার ব্যবস্থা রাখা হয়। পাশাপাশি, যাত্রীদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যকর খাবার ও পর্যাপ্ত পানীয় সরবরাহ করা হয়। কিছু দীর্ঘ ফ্লাইটে ঘুমানোর পড বা বিশেষ বিশ্রামের ব্যবস্থাও থাকে, যাতে যাত্রীরা আরাম করে বিশ্রাম নিতে পারেন।
বিশ্বের দীর্ঘতম ফ্লাইটগুলো আধুনিক বিমান চলাচল শিল্পের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এই ফ্লাইটগুলো শুধুমাত্র আমাদের যাতায়াতের পদ্ধতিকেই পরিবর্তন করেনি, বরং দূরত্বের ধারণাকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে। ভবিষ্যতে আরও দীর্ঘ এবং আরামদায়ক ফ্লাইটের প্রত্যাশায় আমরা অপেক্ষায় আছি!
দীর্ঘতম ফ্লাইটগুলো সম্পর্কে আপনার আর কোন প্রশ্ন আছে?