উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো খাওয়া উচিত নয়?

জেনেনিন উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো আপনার খাদ্যাভ্যাস থেকে বাদ দিবেন!

উচ্চ রক্তচাপ, যা ‘নীরব ঘাতক’ নামেও পরিচিত, বর্তমানে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি হৃদরোগ, স্ট্রোক, এবং কিডনি জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। ঔষধের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু খাবার রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ বাড়াতে পারে, তাই সেগুলোকে পরিহার করা বা সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ।

আসুন জেনে নিই, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো আমাদের খাদ্যাভ্যাস থেকে বাদ দেওয়া উচিত

অতিরিক্ত লবণ বা সোডিয়াম

লবণ
অতিরিক্ত সোডিয়াম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে তা শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায় | Image by Marek from Pixabay

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বর্তমান সময়ে একটি সাধারণ অথচ গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে সোডিয়ামের প্রধান উৎস হলো লবণ। অনেকেই অজান্তেই দৈনন্দিন খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করছেন, যা শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

বিশেষ করে কাঁচা লবণ খাওয়ার অভ্যাস একেবারেই পরিহার করা উচিত। অনেকেই খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য টেবিলে অতিরিক্ত কাঁচা লবণ ছিটিয়ে খান, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। একইভাবে, প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাত খাবারে লবণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। যেমন চিপস, ক্র্যাকার, পিৎজা, স্যান্ডউইচ, প্রসেসড মাংস (যেমন সসেজ, সালামি), টেস্টিং সল্ট, বিট লবণ, সয়া সস, মেয়োনিজ, ইস্ট এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানড ফুড—এইসব খাবারে প্রচুর সোডিয়াম থাকে যা উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই এসব খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

এছাড়া, আমাদের খাদ্যের একটি অংশ হলো আচার ও চাটনি, যা অনেকেই পছন্দ করেন। কিন্তু এসব খাবারে প্রচুর তেল ও লবণ ব্যবহৃত হয়, যা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। একইভাবে, লবণ দিয়ে সংরক্ষিত শুঁটকি জাতীয় খাবারেও সোডিয়ামের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকে। তাই যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন বা ঝুঁকিতে আছেন, তাদের জন্য এসব খাবার থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।

আরও দেখুনঃ উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কোন খাবারগুলো খাবেন?

চর্বি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার

লাল মাংস
চর্বি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার খেলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এছাড়া অতিরিক্ত তেল ও মাখনযুক্ত খাবারও উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায় | Photo by Usman Yousaf on Unsplash

অতিরিক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরল আমাদের রক্তনালীগুলোর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে লাল মাংস—যেমন গরু, খাসি ও মহিষের মাংস—এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন কলিজা, মগজ ইত্যাদিতে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল থাকে। এগুলো নিয়মিত খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি তৈরি হয়। একইভাবে, ডিমের কুসুম এবং মুরগির চামড়াও কোলেস্টেরল ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটে ভরপুর। অনেকেই মনে করেন যে ডিম প্রোটিনের ভালো উৎস, যা সত্যি, কিন্তু প্রতিদিন কুসুমসহ ডিম খাওয়া হৃদস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে যাদের রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের সমস্যা রয়েছে।

অতিরিক্ত তেল ও মাখনযুক্ত খাবারও এড়িয়ে চলা উচিত। কেক, পেস্ট্রি, লুচি, পরোটা, আইসক্রিম, মাখন, ঘি ইত্যাদি খাবারে ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে, যা রক্তের চর্বির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত এসব খাবার খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এছাড়া চিজ বা পনির একটি বহুল ব্যবহৃত খাদ্য, বিশেষ করে ফাস্ট ফুড ও বিভিন্ন স্ন্যাকসে। কিন্তু চিজে উচ্চমাত্রার সোডিয়াম ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা একদিকে কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং অন্যদিকে রক্তচাপের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে।

চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার

চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার
অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে | Image by 俊哉 佐伯 from Pixabay

অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার আমাদের শরীরের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর। এসব খাবার অতিরিক্ত ক্যালরি সরবরাহ করে, যা শরীরে জমে ওজন বৃদ্ধি ঘটায়। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম প্রধান কারণ। শরীরের ওজন যত বেশি হয়, হৃদযন্ত্রকে তত বেশি পরিশ্রম করতে হয় রক্ত সঞ্চালনের জন্য, ফলে রক্তচাপ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়াও, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত চিনি শুধুমাত্র ওজন বৃদ্ধির মাধ্যমে নয়, বরং সরাসরি রক্তচাপ বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশেষ করে কেক, পেস্ট্রি, কোমল পানীয় (যেমন– কোলা, সফট ড্রিঙ্কস), চকলেট, মিষ্টি, কনডেন্সড মিল্ক এবং চিনিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার—এসবের মধ্যে চিনি থাকে বিপজ্জনক মাত্রায়। অনেক সময় এই ধরনের খাবারে লুকানো চিনি থাকে, যা আমরা বুঝতেই পারি না, কিন্তু তা আমাদের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে থাকে। নিয়মিত এসব খাবার খেলে শুধু রক্তচাপই নয়, ডায়াবেটিস, চর্বি জমা, ফ্যাটি লিভার ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল

Tea and Coffee
ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল গ্রহন করা থেকে বিরত থাকুন দীর্ঘমেয়াদে এটি শরীরের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে | Image by Anja from Pixabay

ক্যাফেইন, যা মূলত চা, কফি, এনার্জি ড্রিঙ্ক ও কিছু সফট ড্রিঙ্কে পাওয়া যায়, তা শরীরে স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। এর ফলে হঠাৎ করে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং সাময়িকভাবে রক্তচাপও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যারা নিয়মিত চা বা কফি খান, তাদের জন্য প্রতিদিন দুই থেকে তিন কাপের বেশি ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় গ্রহণ করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

অন্যদিকে, অ্যালকোহল বা মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অ্যালকোহল সরাসরি রক্তনালীর প্রাকৃতিক কার্যপ্রণালীকে ব্যাহত করে, যার ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয়, যারা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ সেবন করেন, তাদের ক্ষেত্রে অ্যালকোহল ওষুধের কার্যকারিতা হ্রাস করে দিতে পারে, ফলে ওষুধ গ্রহণ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ হার্ট, লিভার এবং কিডনির ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে, যা উচ্চ রক্তচাপকে আরও জটিল করে তোলে।

ফাস্ট ফুড ও বেকারি খাবার

ফাস্ট ফুড
ফাস্ট ফুডে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম (লবণ), প্রিজারভেটিভ, কৃত্রিম রঙ এবং ক্ষতিকারক চর্বি থাকে যা উচ্চ রক্তচাপের কারন হতে পারে | Photo by Robin Stickel

ফাস্ট ফুড এবং বেকারি জাতীয় খাবার বর্তমান প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজলভ্যতা, আকর্ষণীয় স্বাদ এবং দ্রুত পরিবেশনের কারণে এইসব খাবার অনেকের কাছে প্রিয় হলেও, এগুলোর পুষ্টিগুণ প্রায় নেই বললেই চলে। বরং এই খাবারগুলোতে থাকে বিপুল পরিমাণে সোডিয়াম (লবণ), প্রিজারভেটিভ, কৃত্রিম রঙ এবং ক্ষতিকারক চর্বি, যা আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য এসব উপাদান অত্যন্ত ক্ষতিকর। অতিরিক্ত সোডিয়াম রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি জটিলতার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ফাস্ট ফুড যেমন বার্গার, পিৎজা, ফ্রাইড চিকেন এবং বেকারি আইটেম যেমন কেক, পেস্ট্রি, পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদিতে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ ও কৃত্রিম রঙ শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘদিন ধরে এগুলো খাওয়ার ফলে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। এসব খাবারে ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণও অনেক বেশি, যা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং রক্তনালীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।

প্রক্রিয়াজাত মাংস

প্রক্রিয়াজাত মাংস
প্রক্রিয়াজাত মাংসে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম (লবণ) থাকে যা রক্তচাপ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ | Photo by Fitri Ariningrum on Unsplash

সসেজ, হটডগ, সালামি(Salami), বেকন ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত মাংস আমাদের আধুনিক খাদ্যাভ্যাসে খুব সহজেই জায়গা করে নিয়েছে, বিশেষ করে ফাস্ট ফুড বা সহজে প্রস্তুতযোগ্য খাবারের অংশ হিসেবে। তবে এইসব প্রক্রিয়াজাত মাংসের পুষ্টিগুণের তুলনায় ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ অনেক বেশি, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম (লবণ) থাকে, যা রক্তচাপ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। অতিরিক্ত সোডিয়াম শরীরে পানির ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় এবং রক্তনালীগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, ফলে রক্তচাপ দ্রুত বেড়ে যায়।

প্রক্রিয়াজাত স্যুপ ও সস

প্রক্রিয়াজাত স্যুপ ও সস
প্রক্রিয়াজাত স্যুপ ও সসের সংরক্ষণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত লবণ এবং নানা ধরনের রাসায়নিক প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় যা রক্তচাপ বাড়ায় | Image by Anastasiya Badun from Pixabay

অনেকেই স্যুপ ও বিভিন্ন সসকে স্বাস্থ্যকর খাবার মনে করে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। তবে বাজারে সহজলভ্য অধিকাংশ প্রক্রিয়াজাত স্যুপ এবং সস আদতে উচ্চমাত্রায় সোডিয়ামযুক্ত, যা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এইসব প্রস্তুতজাত খাবারে স্বাদ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত লবণ এবং নানা ধরনের রাসায়নিক প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। ফলস্বরূপ, নিয়মিতভাবে এসব খাবার গ্রহণ করলে শরীরে সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুধুমাত্র খাবার পরিহার করাই যথেষ্ট নয়। নিয়মিত শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক চাপ কমানোও জরুরি।
  • যেকোনো ডায়েট পরিবর্তনের আগে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

এই খাবারগুলো পরিহার করে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে এবং এর সাথে সম্পর্কিত জটিলতার ঝুঁকিও কমে যাবে।

মনে রাখবেন, যেকোনো নতুন খাদ্যতালিকা শুরু করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। আপনার স্বাস্থ্য আপনার হাতেই!
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments