কাশি কমানোর ঘরোয়া উপায়, কি করবেন দেখে নিন

কাশির অস্বস্তি দূর করার কিছু কার্যকরী ঘরোয়া উপায়

কাশি একটি অত্যন্ত সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ঠাণ্ডা লাগা,  অ্যালার্জি অথবা পরিবেশ দূষণ যেমন ধোঁয়া বা ধুলোবালির কারণেও কাশির উপদ্রব দেখা দিতে পারে। যদিও বেশিরভাগ কাশিই নিজে থেকে সেরে যায় এবং সাধারণত গুরুতর হয় না, তবুও কাশির কারণে সৃষ্ট অস্বস্তি দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। 

তাই, অস্বস্তি কমানো এবং দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য কিছু কার্যকরী ঘরোয়া উপায় অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। এই পদ্ধতিগুলো সহজলভ্য এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত হওয়ায় অনেকেই ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। নিচে তেমনই কিছু কার্যকরী ঘরোয়া উপায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, যা আপনার কাশি নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে।

মধু

মধু
কাশি কমাতে এক চামচ মধু খান | Photo by Benyamin Bohlouli on Unsplash

কাশির জন্য মধু একটি অত্যন্ত কার্যকর প্রতিকার। এর কার্যকারিতার মূলে রয়েছে এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য। মধু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, যা অনেক সময় কাশির কারণ হয়ে থাকে। একইসাথে, এটি প্রদাহ কমিয়ে গলার ফোলাভাব এবং অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করে। মধু সেবনের বিভিন্ন সহজ উপায় রয়েছে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো এক চামচ মধু সরাসরি খেয়ে নেওয়া। মধুর ঘন টেক্সচার গলার আস্তরণের উপর একটি প্রতিরক্ষামূলক স্তর তৈরি করে, যা জ্বালা কমাতে সাহায্য করে। 

এছাড়া, এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে মধু মিশিয়ে পান করলে তা গলাকে আর্দ্র রাখে এবং কফ নরম করে বের করে দিতে সাহায্য করে। আদা চা বা তুলসি চায়ের সাথে মধু মিশিয়ে পান করাও অত্যন্ত উপকারী। এই মিশ্রণটি শুধু কাশির উপশমই করে না, বরং এর উষ্ণতা এবং ভেষজ উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে এক চামচ মধু খেলে রাতের কাশি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং নির্বিঘ্ন ঘুম নিশ্চিত হয়। সামগ্রিকভাবে, মধু একটি নিরাপদ, প্রাকৃতিক এবং সুস্বাদু প্রতিকার যা কাশির কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে দারুণ কার্যকর।

আরও দেখুনঃ কিভাবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলবেন?

আদা

আদা চা
আদা চা কাশি নিরাময়ের জন্য অনেক উপকারি | Image by Alongkorn Tengsamut from Pixabay

আদা, তার অসাধারণ অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক নিরাময় ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত, গলা ব্যথা এবং কাশির উপশমে অত্যন্ত কার্যকর একটি উপাদান। এটি শুধুমাত্র গলা ব্যথা কমায় না, বরং শ্বাসনালীর পেশী শিথিল করতেও সাহায্য করে, যা কাশির তীব্রতা এবং ফ্রিকোয়েন্সি কমাতে পারে। আদাতে থাকা সক্রিয় যৌগ, যেমন জিঞ্জেরল (gingerol), প্রদাহ কমাতে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গলা ব্যথা এবং কাশির উপশমের জন্য আদা ব্যবহারের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকর উপায়গুলির মধ্যে একটি হল আদা চা। কয়েক টুকরা আদা কুচি করে এক কাপ গরম জলে ফুটিয়ে চায়ের মতো পান করতে পারেন। এই উষ্ণ পানীয়টি গলার অস্বস্তি কমাতে এবং শ্বাস প্রশ্বাস সহজ করতে সাহায্য করে। আদা চায়ের স্বাদ এবং কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য এতে মধু যোগ করা যেতে পারে। মধু নিজেই একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক এবং কফ নিবারক হিসেবে কাজ করে, যা আদার কার্যকারিতার সঙ্গে মিশে আরও দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়তা করে।

লবণ-পানি গার্গল

লবণ-পানি
লবন একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক এটি কফ এবং শ্লেষ্মাকে আলগা করে দেয় | Photo by Towfiqu barbhuiya

গলা ব্যথা এবং কাশির উপশমে লবণ-পানি গার্গল একটি অত্যন্ত কার্যকরী ও সহজলভ্য ঘরোয়া প্রতিকার। এর প্রধান কারণ হলো, লবণ পানি গলা থেকে জমে থাকা শ্লেষ্মা (mucus) পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। যখন আমরা লবণ পানি দিয়ে গার্গল করি, তখন এটি গলার ভেতরের অংশে লেগে থাকা কফ এবং শ্লেষ্মাকে আলগা করে দেয়, যা কাশি এবং অস্বস্তি কমাতে সহায়ক। এছাড়াও, লবণ একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে। এটি গলার ভেতরের ফোলাভাব (inflammation) এবং জ্বালা কমাতে বিশেষভাবে কার্যকরি উপাদান। 

একটি গ্লাস উষ্ণ পানিতে(ঠান্ডা বা গরম পানি নয়, উষ্ণ পানিই সবচেয়ে উপকারী) আধা চা চামচ লবণ ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। লবণ যেন পুরোপুরি পানিতে গুলে যায় তা নিশ্চিত করুন। এই মিশ্রণটি দিয়ে দিনে কয়েকবার গার্গল করুন, বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমানোর আগে। গার্গল করার সময় পানি মুখে নিয়ে কিছুক্ষণ গলা পর্যন্ত ঘুরিয়ে তারপর ফেলে দিন। এটি নিয়মিত ব্যবহার করলে গলা ব্যথা এবং কাশির তীব্রতা দ্রুত কমতে শুরু করে এবং আরাম অনুভূতি হয়।

তুলসী পাতা

তুলসী পাতা
তুলসী একটি ঔষধিগাছ এর অনেক গুনাগুন রয়েছে | Image by Maite Ramos Ortiz from Pixabay

তুলসী পাতায় শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ কমাতে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কাশি এবং ঠান্ডার উপশমে তুলসী ব্যবহারের বিভিন্ন উপায় রয়েছে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো কয়েকটি তুলসী পাতা পরিষ্কার করে পানিতে ফুটিয়ে তুলসী চা তৈরি করা। এই চা দিনে দু-তিনবার পান করলে গলা ব্যথা, কফ এবং নাক বন্ধের সমস্যা থেকে আরাম পাওয়া যায়। তুলসীর উষ্ণ এবং প্রশান্তিদায়ক গুণাবলী শ্বাসযন্ত্রের অস্বস্তি কমাতে বিশেষভাবে কার্যকর।

এছাড়াও, তুলসী পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে সেবন করাও একটি প্রচলিত এবং অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। তুলসীর রস প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং মধু প্রাকৃতিক কফ নিবারক হিসেবে কাজ করে। এক চামচ তুলসী পাতার রসের সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে দিনে একবার বা দুবার সেবন করলে কাশি এবং ঠান্ডার লক্ষণগুলি দ্রুত কমে আসে। তুলসীর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলিও সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে, যা ঠান্ডার প্রকোপ কমাতে সহায়ক।

গরম পানির ভাপ (স্টিম ইনহেলেশন)

গরম পানির ভাপ
গরম পানির ভাপ নেওয়া কাশির জন্য অত্যন্ত কার্যকরী প্রতিকার | Photo by Georgie Devlin

গরম পানির ভাপ নেওয়া ঠান্ডা লাগা, কাশি বা নাক বন্ধের মতো সমস্যাগুলোর জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকরী এবং প্রাকৃতিক প্রতিকার। যখন আপনি গরম পানির ভাপ গ্রহণ করেন, তখন এর উষ্ণ আর্দ্রতা আপনার নাক এবং গলার ভেতরের শ্লেষ্মা বা কফকে পাতলা করে দেয়। এই পাতলা শ্লেষ্মা শরীর থেকে সহজে বেরিয়ে যেতে পারে, যার ফলে কাশি কমে আসে এবং কফ জমে থাকার অস্বস্তি দূর হয়।

ভাপ নেওয়ার জন্য একটি বড় পাত্রে গরম পানি নিন, যেন যথেষ্ট পরিমাণে ভাপ উৎপন্ন হয় এমন গরম। এরপর একটি তোয়ালে দিয়ে আপনার মাথা সম্পূর্ণভাবে ঢেকে ফেলুন এবং পাত্রের উপর ঝুঁকে সাবধানে গরম পানির ভাপ নিন। খেয়াল রাখবেন যেন খুব বেশি কাছে না চলে যান, এতে ত্বক পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চোখ বন্ধ রাখতে পারেন যাতে গরম ভাপ সরাসরি চোখে না লাগে। আপনি চাইলে পানিতে কয়েক ফোঁটা ইউক্যালিপটাস তেল যোগ করতে পারেন। ইউক্যালিপটাস তেল শ্বাসতন্ত্রের জন্য উপকারী এবং এটি বন্ধ নাক খুলতে এবং শ্লেষ্মা পরিষ্কার করতে আরও বেশি সাহায্য করে।

পর্যাপ্ত পানি পান

এক গ্লাস পানি
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন | Photo by manu schwendener on Unsplash

শরীরে পানির অভাবে শ্লেষ্মা ঘন হয়ে যায়, যা কাশির প্রধান কারণ। যখন শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পায় না, তখন শ্লেষ্মা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আঠালো হয়ে যায় এবং ফুসফুস ও শ্বাসনালী থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। এই ঘন শ্লেষ্মা কাশিকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করে। তাই কাশির সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পানি শ্লেষ্মাকে পাতলা করতে সাহায্য করে, যার ফলে এটি শরীর থেকে সহজে বেরিয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। সাধারণ পানির পাশাপাশি, ফলের রস, বিভিন্ন স্যুপ এবং হারবাল চাও পান করতে পারেন। ডাবের পানি, লেবুর পানি, অথবা আদার চা-ও শ্লেষ্মা পাতলা করতে এবং গলাকে আর্দ্র রাখতে সহায়ক। মনে রাখবেন, শুধু কাশি হলেই নয়, সুস্থ থাকতে এবং শরীরের সঠিক কার্যকারিতার জন্য নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা অপরিহার্য।

হলুদ

হলুদ
হলুদ একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক উপাদান যার বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে | Photo by Ksenia Chernaya

হলুদ একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক উপাদান যা তার অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য সুপরিচিত। এটি শুধু একটি মশলাই নয়, এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবেও কাজ করে। হলুদে থাকা কারকিউমিন নামক যৌগটি এর ঔষধি গুণাবলীর প্রধান কারণ। এই কারকিউমিন শরীরের প্রদাহ কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কাশির ক্ষেত্রে, এটি গলা এবং শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ কমিয়ে আরাম দিতে পারে।

কাশির চিকিৎসায় হলুদ ব্যবহারের একটি সহজ এবং কার্যকর উপায় হলো গরম দুধের সাথে হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে পান করা। এক গ্লাস উষ্ণ দুধের সাথে এক চা চামচ হলুদ গুঁড়ো ভালোভাবে মিশিয়ে ঘুমানোর আগে পান করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। দুধের উষ্ণতা গলাকে আরাম দেয় এবং হলুদের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাবলী কাশি কমাতে সাহায্য করে। এটি শ্বাসতন্ত্রের জমাট বাঁধা কফ পরিষ্কার করতেও সহায়ক হতে পারে, যা কাশির প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি।

সতর্কতা

যদি কাশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, গুরুতর আকার ধারণ করে, এর সাথে জ্বর, শ্বাসকষ্ট অথবা বুকে ব্যথা হয়, তবে দেরি না করে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ঘরোয়া প্রতিকারগুলো কেবল প্রাথমিক উপশমের জন্য, কোনো গুরুতর সমস্যার সমাধান নয়।
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments