চুল পড়া বন্ধ করার উপায়

চুল পড়া বন্ধ করার সহজ উপায় এবং ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে জানুন

চুল পড়া আজকাল একটি অতি পরিচিত সমস্যা, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত চুল ঝরে যাওয়া এবং চুলের ঘনত্ব কমে যাওয়া আমাদের আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দিতে পারে, যা আমাদের সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এই সমস্যা নিয়ে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে এবং কিছু সহজ ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করলে চুল পড়া অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, এমনকি নতুন চুল গজানো এবং চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি করাও সম্ভব। 

তাই আজকে আমরা চুল পড়া বন্ধ করার বিষয় কিছু অত্যন্ত কার্যকর উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা আপনাদের চুলের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে।

চুল পড়ার কারণ

চিকিৎসার আগে চুল পড়ার কারণ জানা জরুরি।
চিকিৎসার আগে চুল পড়ার কারণ জানা জরুরি | Photo by Towfiqu barbhuiya on Unsplash

চুল পড়ার চিকিৎসার আগে এর কারণ জানা জরুরি। চুল পড়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত কারণ হলো বংশগতি। যদি আপনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে টাক পড়ার প্রবণতা থাকে, তাহলে আপনারও চুল পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এছাড়াও, শরীরের হরমোনের পরিবর্তন ফলেও চুল পরে। গর্ভাবস্থা, সন্তান প্রসব, মেনোপজ এবং থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার মতো পরিস্থিতিতে হরমোনের ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে পারে, যার ফলে চুল ঝরে যেতে পারে।

বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, যেমন কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি এবং কিছু নির্দিষ্ট ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও চুল পড়তে দেখা যায়। দৈনন্দিন জীবনের অতিরিক্ত মানসিক চাপও চুল পড়ার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব, বিশেষ করে প্রোটিন, আয়রন এবং কিছু ভিটামিনের ঘাটতি চুলের স্বাস্থ্য দুর্বল করে তোলে এবং চুল ঝরে যায়। 

চুলের অযত্ন, যেমন অতিরিক্ত তাপ(হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার), খুব টাইট করে চুল বাঁধা অথবা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করার কারণে চুল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ঝরে যায়। কিছু বিশেষ রোগ, যেমন মাথার ত্বকের সংক্রমণ বা অ্যালোপেসিয়া এরিয়াটার মতো অটোইমিউন রোগও চুল পড়ার কারণ হতে পারে। এবং স্বাভাবিকভাবেই, বয়স বাড়ার সাথে সাথে চুলের ঘনত্ব কমতে পারে এবং চুল পাতলা হয়ে যেতে পারে। 

চুল পড়া বন্ধ করার সহজ উপায়

চুল পড়া বন্ধ করতে সঠিক পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি
চুল পড়া বন্ধ করতে সঠিক পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি | Image by Ryan McGuire from Pixabay

চলুন দেখে নেওয়া যাক চুল পড়া বন্ধ করার সহজ উপায়গুলো কি কি 

সুষম খাদ্যাভ্যাসঃ চুলের স্বাস্থ্য সরাসরি আমাদের খাদ্যাভ্যাসের উপর নির্ভরশীল। চুলের গোড়া মজবুত করতে এবং স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল পেতে প্রোটিন একটি অপরিহার্য উপাদান। ডিম, মাছ, মাংস, এবং বিভিন্ন ডাল প্রোটিনের ভালো উৎস। এছাড়াও, আয়রন চুলের ফলিকলে অক্সিজেন সরবরাহ করতে সাহায্য করে, যার অভাবে চুল পড়তে পারে। 

সবুজ শাকসবজি, মাংসের কলিজা এবং শুকনো ফলে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। জিঙ্কও চুলের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কুমড়োর বীজ, বাদাম এবং বিভিন্ন শস্য জিঙ্কের ভালো উৎস। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, বিশেষ করে বায়োটিন, চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য খুবই জরুরি। ডিম, দুধ, এবং শস্যজাত খাবারে এটি পাওয়া যায়। ভিটামিন ডি-এর অভাবও চুল একটি পড়ার কারণ। সূর্যের আলো এবং কিছু নির্দিষ্ট খাবার, যেমন – তৈলাক্ত মাছ ভিটামিন ডি-এর উৎস। তাই, চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে একটি সুষম এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

আরও দেখুনঃ কিভাবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলবেন?

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যাপ্ত ঘুমঃ অতিরিক্ত মানসিক চাপ চুল পড়ার একটি অন্যতম কারণ। যখন আমরা মানসিক চাপে থাকি, তখন আমাদের শরীরে কিছু হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। যোগাআসন, মেডিটেশন, গান শোনা অথবা পছন্দের বা শখের কোন কাজ করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়। এছাড়াও, প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো শরীরের পাশাপাশি চুলের স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলে এবং চুলের বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

চুলের সঠিক পরিচর্যাঃ চুলের বাহ্যিক যত্নও চুল পড়া কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

  • সঠিক শ্যাম্পু নির্বাচন ও ব্যবহারঃ চুলের ধরন অনুযায়ী সালফেট মুক্ত এবং হালকা শ্যাম্পু ব্যবহার করা উচিত। অতিরিক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুলের প্রাকৃতিক তেল চলে যায়, যা চুলকে দুর্বল করে তোলে। তাই সপ্তাহে ২-৩ বারের বেশি শ্যাম্পু করা উচিত নয়। শ্যাম্পু করার সময় আলতোভাবে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করা উচিত, জোরে ঘষা উচিত নয়।
  • কন্ডিশনারের ব্যবহার করুনঃ শ্যাম্পুর পরে অবশ্যই ভালো মানের কন্ডিশনার ব্যবহার করা উচিত। কন্ডিশনার চুলকে মসৃণ করে এবং জট ছাড়াতে সাহায্য করে, ফলে চুল আঁচড়ানোর সময় কম ভাঙে।
  • ভেজা চুল আঁচড়ানো বন্ধ করুনঃ ভেজা চুল সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় থাকে এবং খুব সহজে ভেঙে যায়। তাই চুল শুকানোর পরে আলতোভাবে মোটা দাঁতের চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো উচিত। তাড়াহুড়ো করে বা জোরে আঁচড়ালে চুল পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
  • সঠিক নিয়মে চুল বাঁধুনঃ অতিরিক্ত টাইট করে চুল বাঁধলে চুলের গোড়ায় টান লাগে এবং চুলের ফলিকল দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে চুল পড়া শুরু হতে পারে। তাই ঢিলেঢালা করে চুল বাঁধা উচিত এবং একই ধরনের বাঁধন দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখা উচিত নয়।
  • রাসায়নিক চিকিৎসা পরিহার করুনঃ চুলে ঘন ঘন রঙ, ব্লিচ বা অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে চুলের প্রাকৃতিক গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চুল দুর্বল হয়ে পড়ে। একান্তই প্রয়োজন হলে ভালো মানের পণ্য ব্যবহার করা উচিত এবং অভিজ্ঞ কারো সাহায্য নেওয়া উচিত।
  • হেয়ার ড্রায়ার ও হিটিং সরঞ্জাম ব্যবহারে সতর্ক থাকুনঃ হেয়ার ড্রায়ার এবং অন্যান্য হিটিং সরঞ্জাম থেকে নির্গত অতিরিক্ত তাপ চুলের আর্দ্রতা কেড়ে নেয় এবং চুলকে শুষ্ক ও ভঙ্গুর করে তোলে। তাই যতটা সম্ভব প্রাকৃতিকভাবে চুল শুকানো উচিত। যদি হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করতেই হয়, তবে ঠান্ডা সেটিং-এ এবং কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ব্যবহার করা উচিত।
  • গরম তেলের ম্যাসাজঃ সপ্তাহে একবার গরম তেল (যেমন – নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, বাদাম তেল) হালকাভাবে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং চুলের গোড়া মজবুত হয়। তেল হালকা গরম করে মাথার ত্বকে ভালোভাবে লাগিয়ে এক ঘণ্টা পর হালকা শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

চুল পড়া বন্ধ করার ঘরোয়া প্রতিকার

ভেষজ ঔষধি
কিছু ভেষজ ঔষধির মাধ্যমেও চুল পড়া আটকানো যায় | Image by RosinaS from Pixabay

কিছু প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে চুল পড়া কমানো এবং চুলের বৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব।

পেঁয়াজের রসঃ পেঁয়াজের রসে প্রচুর পরিমাণে সালফার থাকে, যা চুলের ফলিকলকে উদ্দীপিত করে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। একটি পেঁয়াজ ব্লেন্ড করে রস বের করে নিন এবং তুলোর সাহায্যে মাথার ত্বকে লাগান। ৩০ মিনিট পর হালকা শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। পেঁয়াজের গন্ধ কমাতে এর সাথে সামান্য লেবুর রস মেশানো যেতে পারে।

মেথিঃ মেথি চুলের জন্য একটি অসাধারণ উপাদান। রাতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সকালে তা বেটে মিহি পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগিয়ে ৩০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। মেথিতে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান চুলকে মজবুত করে এবং চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে।

অ্যালোভেরাঃ অ্যালোভেরার জেল মাথার ত্বকের জন্য খুবই শান্তিদায়ক এবং এটি চুল পড়া কমাতে সহায়ক। তাজা অ্যালোভেরার পাতা থেকে জেল বের করে সরাসরি মাথার ত্বকে লাগান এবং কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন। অ্যালোভেরাতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং ময়েশ্চারাইজিং বৈশিষ্ট্য চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?

ডাক্তার
ডাক্তারের পরামর্শ নিন | Photo by TopSphere Media on Unsplash

যদি আপনি লক্ষ্য করেন আপনার চুল পড়ার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, অথবা যদি সাধারণ ঘরোয়া পরিচর্যা পদ্ধতি অবলম্বন করার পরেও চুল পড়ার কোনো উন্নতি না হয়, তবে এই লক্ষণগুলিকে হালকাভাবে নেবেন না। এক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ ডার্মাটোলজিস্টের (ত্বক বিশেষজ্ঞ) শরণাপন্ন হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখবেন, চুল পড়া একটি জটিল সমস্যা হতে পারে এবং এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। কেবলমাত্র একজন ত্বক বিশেষজ্ঞ আপনার চুলের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চুল পড়ার সঠিক কারণটি নির্ধারণ করতে পারবেন।

তাছাড়া, ডার্মাটোলজিস্ট কেবল কারণ নির্ণয়ই করবেন না, বরং তিনি আপনার বিশেষ অবস্থার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দেবেন। ঘরোয়া পদ্ধতি হয়তো কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক উপকার দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর সমস্যার সমাধানে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এবং চিকিৎসার বিকল্প নেই।

চুল পড়া বন্ধ করা এবং চুলকে ঘন করা একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ধৈর্য ধরুন এবং নিয়মিত এই পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করুন। সঠিক যত্ন নিলে আপনি অবশ্যই আপনার চুলের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবেন এবং ঘন, সুন্দর চুল ফিরে পাবেন।

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments